আজ ১৯ শে এপ্রিল,চার্লস ডারউইন এর ১৪০ তম মৃত্যুবার্ষিকী
চার্লস ডারউইন – আধুনিক জীববিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। দেড়শো বছরেরও অধিক পূর্বে এই ইংরেজ প্রকৃতিবিদ জীবের বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কিত যে মতবাদ ব্যক্ত করে গেছেন, আজও তা নিয়ে বিজ্ঞানমহলে আলোচনা হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। বিবর্তন বিষয়ে ইতোপূর্বে সক্রেটিস সহ বিভিন্ন দার্শনিক ও বিজ্ঞানী ধারণা দিয়েছিলেন কমবেশি, তবে বিবর্তন বিষয়ক সর্বপ্রথম বিশ্বাসযোগ্য ও অকাট্য ব্যখ্যা দিয়েছিলেন ডারউইন-ই। যেই ডারউইনকে বিজ্ঞানী হওয়া দূরে থাক, রীতিমতো বুদ্ধিহীন ও নিষ্কর্মা হিসেবে মনে করতেন তাঁর শিক্ষক থেকে শুরু করে পরিবার, বন্ধুবান্ধব সকলেই, সেই ডারউইনই আজ স্মরণীয় হয়ে আসছেন নিউটন, আইন্সটাইনসহ বিজ্ঞানের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের নামের পাশে।
আজ ১৯ শে এপ্রিল, এই মহান বিজ্ঞানীর ১৪০ তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি চিরতরে ফিরে যান সেই প্রকৃতির নিকট, যে প্রকৃতির রহস্যোদঘাটনে তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রায় পুরোটা জীবনকাল।
জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা :
১২ ই ফেব্রুয়ারি, ১৮০৯। ব্রিটেনের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চার্লস ডারউইন। বাবা রবার্ট ডারউইন ছিলেন একজন চিকিৎসক। মাত্র আট বছর বয়সে মাকে হারানো চার্লস ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেশ চুপচাপ ও পর্যবেক্ষণীয় স্বভাবের। প্রচলিত পড়াশোনার ক্ষেত্রে তাঁর উৎসাহ-উদ্দীপনা ছিলো না কখনোই। কিন্তু তিনি যেসকল সূক্ষ্ম ও আপাতদৃষ্টে অপ্রয়োজনীয়তা বিষয় বিচক্ষণতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতেন, তা ছিলো সেই সময়ে বিরল। নানান অদ্ভুত জিনিস সংগ্রহ করা ছিলো তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। শামুক-ঝিনুক থেকে শুরু করে পুরাতন ভাঙা জিনিসপত্র, নুড়িপাথর সহ যাবতীয় অদ্ভুত জিনিসপত্র তাঁর বাক্স ও পড়ার টেবিলে থাকতো। বাল্যকালে পঠিত একটি বই থেকে দেশবিদেশের নানান অদ্ভুত জিনিসের ব্যাপারে জানার পর বিশ্বভ্রমণের প্রতি তাঁর জন্মেছিলো অধীর আগ্রহ। লেখাপড়ার প্রতি উদাসীনতার কারণে শিক্ষকেরা তার উপর বরাবরই ছিলেন হতাশ। চিকিৎসক পিতার আশা ছিলো সন্তানও বুঝি তাঁর মতোই চিকিৎসক হবেন। সেই আশায় চার্লসকে পাঠানো হয় এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে। ওই সময়টাতে ক্লোরোফর্ম জাতীয় কোনো চেতনানাশক না থাকায় অপারেশনের সময় রোগীদের আর্তনাদ ছিলো করূণ হৃদয়ের চার্লসের পক্ষে অসহনীয়। এক পর্যায়ে যখন বাবার কাছে তিনি স্বীকার করে বসেন যে তাঁর পক্ষে এই ডাক্তারি পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, শিক্ষকদের মতো নৈরাশ্য স্পর্শ করে পিতা রবার্টকেও। চার্লসকে বংশের কলঙ্ক আখ্যা দেন তিনি। রবার্ট চাইতেন না তাঁর পুত্রের জীবনটা বড়লোকের বখে যাওয়া সন্তানের মতো অপচয় হোক। চার্লসকে পাঠালেন ক্যামব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ধর্মতত্ত্ব পড়ার জন্য। বরাবরের মতো এবারও চার্লস উদাসীনই রয়ে গেলেন পড়াশোনার প্রতি। বরং, বাইবেল পড়ার চেয়ে বীটল পোকা সংগ্রহে সময় দিতেন অনেক বেশি। প্রবল অনুসন্ধিৎসু স্বভাবের ডারউইন কখনোই চার্চের পাদ্রীর ন্যায় রুক্ষণশীল মনোভাব ধারণ করতে পারেন নি। বাল্যকালের সেই বিশ্বভ্রমণের ফ্যাসিনেশন তাড়া করে বেরিয়েছে তাঁকে পুরো ছাত্রজীবন জুড়ে। কৌতূহলী চোখে ডারউইন যাবতীয় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এমন এমন সব তথ্য ছাত্রাবস্থায়ই সংগ্রহ করে বসেন যা কোনো বইপুস্তকেও পাওয়া যেত না বললেই চলে। তাঁর বন্ধুরা চিরকালই এসব নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করতো। কেউ কেউ প্রহসনের সুরে বলতো – “ডারউইন পণ্ডিত হবে দেখছি।” কে জানতো, তাদের এই প্রহসনীয় ভবিষ্যদ্বাণী একটা সময় সুদূর কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাবে!
এইচ. এম. এস. বিগল ও একটি দীর্ঘ গবেষণার সূচনা :
অতঃপর এই ক্যামব্রিজেই উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন ডারউইন। এ সময় উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক জন স্টিভেন্স হেন্সলো’র সাথে তাঁর সখ্যতা তৈরি হয়। ডারউইন ছিলেন হেন্সলো’র প্রিয় ছাত্রদের একজন। হেন্সলো’র সুবাদেই ডারউইনের সুযোগ হয় সার্ভে শিপ তথা জরিপকারী জাহাজ ‘এইচ. এম. এস. বিগল’ এ বিনা বেতনে প্রকৃতিবিদ হিসেবে যোগদান করার। পূরণ হয় তাঁর শৈশবের সেই বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন। দীর্ঘ পাঁচ বছরব্যাপী এই ভ্রমণে দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন মহাদেশের দ্বীপপুঞ্জ হয়ে ভারত মহাসাগর ও উত্তমাশা অন্তরীপ ঘুরে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, অন্যান্য জীব ও ফসিল। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে ভ্রমণকালে প্রাকৃতিক নির্বাচন ও বিবর্তন সংক্রান্ত প্রাথমিক ধারণা লাভ করেন তিনি। তাঁর এই বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘দ্য ভয়েজ অব দ্য বিগল’ তাঁকে জনপ্রিয় লেখকের খ্যাতি এনে দেয়। পাঁচ বছরের এ ভ্রমণে লব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করেন গবেষণা। প্রায় বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলতে থাকা এ গবেষণারই ফল ছিলো তাঁর ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত মাস্টারপিস ‘অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ’।
অন দ্য অরিজিন অব স্পিসিজ ও যূগান্তকারী এক মতবাদের সূচনা :
১৮৩৬ সালে বিগল জাহাজ ইংল্যান্ডে ফেরার পর ডারউইন তাঁর পাঁচ বছরব্যাপী ভ্রমণের পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ শুরু করেন ও চেনাশোনা বিজ্ঞানী বন্ধুদের সাথে তাঁর ধারণাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন – যাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন প্রকৃতিবিদ আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস। তাঁরই আহবানে ১৮৫৯ সালে ডারউইন প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাততম বই ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ’, যেখানে তিনি তাঁর বৈপ্লবিক ‘বিবর্তন তত্ত্ব’ প্রদান করেন।
ডারউইন ও ওয়ালেস মিলে যে তত্ত্ব প্রদান করেন তার প্রতিপাদ্য বিষয়গুলাে হলাে-
১। অত্যধিক বংশ বৃদ্ধির হার (Prodigality of production)
প্রত্যেক জীবে জ্যামিতিক হারে বংশ বৃদ্ধির একটা প্রবণতা দেখা যায়।
এককোষী জীব প্যারামেসিয়াম বছরে প্রায় ৬০০ বার জনন কার্য সম্পন্ন করে। এই ক্ষুদ্র প্যারামেসিয়াম এর সকল বংশধর বেঁচে থাকলে পৃথিবী ভরে যেত। ডারউইন হিসাব করে দেখিয়েছেন যে, প্রতি জোড়া হাতি দম্পতি ৯০ বৎসরের জীবনকালে একটি করে মাত্র ৬ বার বাচ্চা দেয়, যদি সবগুলাে বাচ্চা বেঁচে থাকতাে এবং প্রতিটি স্ত্রী শাবক বেঁচে থেকে অনুরূপভাবে বংশ বৃদ্ধি করতাে তবে ৭৫০ বছরে প্রায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ হাতি হতাে।
কিন্তু তা হয়না। প্রজাতির সংখ্যা মােটামুটি অপরিবর্তিত থাকে।
২। স্থান ও খাদ্যের সীমাবদ্ধতা (Limitation of Food and Space)
যে হারে জীব উৎপন্ন হয় সে অনুপাতে পৃথিবীতে স্থান ও খাদ্য নেই। এ অবস্থায় ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত জীব উৎখাত করতে একাধিক প্রভাব বিজড়িত হয়ে পড়ে।
৩। জীবন ধারণের জন্য সংগ্রাম (struggle for existence)
ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি জীব উৎপন্ন হওয়ায় অস্তিত্ব বজায় রাখার নিমিত্তে খাদ্য, স্থান প্রভৃতির জন্য সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠে। এ সংগ্রাম তিন ধরনের। যথা-
ক.অন্ত:প্রজাতিক সংগ্রাম (Intraspecific struggle)
একই প্রজাতির জীবের মধ্যে খাদ্য, আশ্রয়, প্রজনন, ভূমি ইত্যাদির জন্য সংগ্রামকেই অন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম বলে।
খ. আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রাম (Interspecific struggle)
ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির জীবের মধ্যে সংগ্রামকে বুঝায়। এই সংগ্রামে সম্পর্কটি সাধারণত খাদ্য ও খাদকের মধ্যে বিরাজমান।
গ. পরিবেশগত সংগ্রাম(Environmental stuggle)
জীবের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পরিবেশের সাথে (যেমন- খরা, প্লাবন, শীত, ঝড়, বৃষ্টি প্রভৃতি) সংগ্রামকে বুঝায়।
৪। প্রকরণ (Variation)
পৃথিবীতে কোন দুইটি জীব হুবহু একরূপ নয়। একই প্রজাতির জীবের মধ্যে, এমনকি একই পিতা-মাতার সন্তান-সন্ততির মধ্যে প্রকরণ বা ভেদ দেখা যায়। প্রজননের মাধ্যমে এই প্রকরণ সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয়। অর্থাৎ সংগ্রামের ফলে অভিযােজনজাত প্রকরণ বংশানুক্রমে পরিচালিত হয়ে অবশেষে জীবের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ডারউইনের মতে সামান্য ধারাবাহিক প্রকরণই ভিন্ন ভিন্ন জীব উৎপত্তির জন্য দায়ী।
৫। প্রাকৃতিক নির্বাচন বা যােগ্যতমের উর্দ্ধতন (Natural Selection or Survival of the Fittest)
ডারউইনের মতে জীবন ধারণের সংগ্রামে কেবল সেই জীব সাফল্য লাভ করে যাদের দেহে সংগ্রামের পক্ষে অনুকূলে এবং অধিকতর ও সঙ্গত সামঞ্জস্যপূর্ণ অভিযােজন বা প্রকরণ থাকে।
যে সকল জীবের অভিযােজন বা প্রকরণ সংগ্রাম উত্তরণের উপযােগী নহে তারা পৃথিবী হতে বিলীন হয়ে যায়। ডারউইন একে প্রাকৃতিক নির্বাচন (natural selection) বলে অভিহিত করেছেন। Herbert Spencer একে যােগ্যতমের উদ্ধর্তন (survival of the fittest) হিসেবে অ্যাখায়িত করেছেন।
৬। উত্তরলব্ধি ও নতুন প্রজাতির উৎপত্তি (Inheritance and Origin of New Species)
সুবিধাজনক প্রকরণসমূহ প্রাকৃতিক নির্বাচনে উৰ্ত্তীণ হয়ে তারা সন্তান-সন্ততিতে সঞ্চারিত হয়। সন্তান-সন্ততির আরাে প্রকরণের ফলে জনু থেকে জনুতে ক্রমান্বয়ে জীবের বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটে। এভাবে অনেক জনুর পর সামান্য প্রকরণগুলাে সঞ্চিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে নতুন বৈশিষ্ট্যরূপে দেখা যায়। ফলে নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়।
মৃত্যু :
১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে হৃদরোগে আক্রান্ত হন ডারউইন। পরের বছর এপ্রিলে হৃদযন্ত্রে বড় ধরনের আক্রমণ ঘটে ও শয্যাশায়ী হন। অতঃপর, ১৮৮২ সালের ১৯ শে এপ্রিল সন্ধ্যায় পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে বিদায় নেন ডারউইন। তথাকথিত সেই ‘অল্পবুদ্ধি ছাত্র’ কে সমাধিস্থ করা হয় সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের সমাধির পাশে।
References :
1.ডারুইন – সুকুমার রায়
2.জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র – গাজী আজমল, গাজী আসমত
3.https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/nurubrl/30031737
4.https://www.itihasadda.in/charles-darwin/
5.https://www.ajkerpatrika.com/…/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6…
6.https://obakpathshala.com/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0…/
???? Content Credit :
Written By :
Sujoy Banik
General Member,CUSS
Team : Odyssey
Department Of Applied Chemistry & Chemical Engineering
Session : 2021-22
Poster Credit :
Raisa Nuzhat
Assistant IT Secretary
Department Of Computer Science and Engineering
Session : 2019-20
Tag:cuss