আজ ২৬শে জুন ২০২৩, বিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের ৮০ তম মৃত্যু বার্ষিকী
আজ ২৬শে জুন ২০২৩, বিখ্যাত বিজ্ঞানী কার্ল ল্যান্ডস্টেইনারের ৮০ তম মৃত্যু বার্ষিকী।
জন্ম
অস্ট্রিয়ার রাজধানী শহর ভিয়েনায় ১৮৬৮ সালের ১৪ জুন এক সম্ভ্রান্ত ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার। তাঁর বাবা লিওপোল্ড ল্যান্ডস্টাইনার ছিলেন আইন গবেষক এবং ‘ডি প্রেস’ নামক একটি দৈনিক পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। তাঁর মায়ের নাম ছিল ফ্যানি হ্যাস। মাত্র ৬ বছর বয়সে কার্ল তাঁর বাবাকে হারান। এরপর থেকে মায়ের আদর-স্পর্শে বড় হতে থাকেন তিনি।
শৈশব ও শিক্ষা:
শৈশব থেকে কার্লের স্বপ্ন ছিল ডাক্তারি পড়াশোনা করা। ভিয়েনা থেকে ১১৫ মাইল দূরে লিঞ্জ শহরের গ্রামার স্কুলে তার শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেড়িয়ে কার্ল ১৭ বছর বয়সে ঐতিহ্যবাহী ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলে গিয়ে ভর্তি হন। কার্ল বেশ কর্মঠ এবং মনোযোগী ছাত্র ছিলেন। তিনি ছাত্র থাকা অবস্থায় গবেষণার কাজে হাত দেন এবং তাঁর ২৩তম জন্মদিনের কিছুদিন আগে তাঁর ডক্টর অফ মেডিসিন ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি সেই সময় রক্তের উপাদানের উপর মানুষের খাদ্যের প্রভাব নিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করেছিলেন। সবাই যখন ধরে নিয়েছিল কার্ল বেশ বড় ডাক্তার হবেন, ঠিক তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পেশাদার ডাক্তারি আর করবেন না। বরং তিনি একজন গবেষক হওয়ার সংকল্প গ্রহণ করলেন।
গবেষণা:
কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার জীববিদ্যার পাশাপাশি রসায়ন নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন। বিশেষ করে, জৈবিক রসায়নের গূঢ় রহস্য তাঁকে বেশ আকৃষ্ট করতো। তাই তিনি এই বিষয়ে গবেষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গবেষণাগারের প্রাথমিক কলাকৌশল শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি জার্মানি এবং সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন গবেষণাগারে কাজ করেন। তাঁর কর্মসঙ্গী হন তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত রসায়নবিদ এমিল ফিশার। এরপর তিনি ১৮৯৬ সালে ভিয়েনায় ফেরত আসেন। তাঁকে ভিয়েনা হাসপাতালের গবেষক ম্যাক্স ফন গ্রুবারের সহকারী হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হয়। এখানে কর্মরত অবস্থায় নব্য গবেষক কার্ল তাঁর গুরু ফন গ্রুবার এবং সহকর্মী গবেষক পল এরলিকের সাথে এক বৈজ্ঞানিক বিতর্কে লিপ্ত হন।
বিতর্কের শুরুটা ছিল ফন গ্রুবার এবং পল এরলিকের মাঝে। বিতর্কের বিষয় ছিল অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কীভাবে একে অপরের সাথে বিক্রিয়া করে সংযুক্তি গঠন করে। দুজনের সাংঘর্ষিক তত্ত্ব থেকে এই বিতর্কের সূচনা। কার্ল নিজের উদ্যোগে বেশ কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে এই সংযুক্তিকরণের কৌশল আবিষ্কার করেন এবং ফন গ্রুবারের তত্ত্ব সমর্থনের মাধ্যমে এই বিতর্কের অবসান ঘটান। এই এক বিতর্ক পুরো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ বদলে দিয়েছিল। এরপর তিনি রক্তের ‘এগ্লুটিনেশন’ নিয়ে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন। গবেষণাগারে রীতিমতো বিস্ময় হিসেবে উত্থান ঘটলো কার্লের। তাঁর এই গবেষণা তাঁকে আরো মহৎ আবিষ্কারের দিকে ঠেলে দিয়েছিল, যার জন্য আজীবন তাঁকে মানবজাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে যাবে।
রক্তের গ্রুপ বিপ্লব:
তৎকালীন চিকিৎসাবিজ্ঞানে রক্ত সঞ্চালন ছিল অনেকটা মুদ্রা নিক্ষেপের মতো ধোঁয়াশা। নানা রোগে-শোকে এবং দুর্ঘটনায় মানবদেহে রক্তের ঘাটতি দেখা দিত। এই ঘাটতি পূরণের জন্য আরেক মানবদেহ থেকে রক্ত সঞ্চালন খুব একটা সুবিধাজনক প্রক্রিয়া ছিল না। হাতেগোনা কিছু ক্ষেত্র বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই রক্ত সঞ্চালনের পর রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তো। কিন্তু কেন এমন হতো, সেটা কারো জানা ছিল না। তাই রক্ত সঞ্চালনের বিজ্ঞান স্বীকৃত কোনো পদ্ধতিও ছিল না।
রক্ত সঞ্চালনের এই সমস্যা নিয়ে পরিচিত ছিলেন কার্ল ল্যান্ডস্টাইনারও। ১৯০০ সালে তিনি এই রহস্য উদ্ঘাটনের উদ্দেশ্যে গবেষণা শুরু করেন। তিনি বিভিন্ন মানুষের রক্ত সংগ্রহ করে গবেষণাগারে এক রক্তের সাথে আরেক রক্ত মিশিয়ে এর পরিণাম অবলোকন করতে থাকেন। দেখা যেত, কিছু রক্তের মিশ্রণে রক্ত জমাট বেঁধে যেত। অপরদিকে, কিছু ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধতো না। এবং এই জমাট বাঁধার ধরন একরকম ছিল না। এক রক্ত আরেক রক্তের সাথে জমাট বাঁধলেও সেটা অন্য আরেক রক্তের সাথে কোনো জমাট সৃষ্টি করতো না। কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার প্রায় এক বছর নিরলস গবেষণার মাধ্যমে রক্তের অ্যান্টিবডি-এ, অ্যান্টিবডি-বি আবিষ্কার করেন। এরপর এর উপস্থিতি অনুসারে রক্তকে ABO- তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করেন। আরো এক বছর পর তিনি ও তার সহকর্মীগণ চতুর্থ ধরন AB গ্রুপ নির্ণয় করতে সক্ষম হন। এই মহান আবিষ্কারের পর চিকিৎসা বিজ্ঞানে রক্ত সঞ্চালন আর বাঁধা নয়, বরং এক সম্ভাবনা হিসেবে উন্মোচিত হলো।১৯০৩ সালে সর্বপ্রথম এই রক্তের গ্রুপের বাস্তবিক প্রয়োগ সম্পন্ন হয়। কার্ল এবং ম্যাক্স রিখটার নামক গবেষক অপরাধী নির্ণয়ে রক্ত পরীক্ষা করেন। এরপর থেকে অপরাধ বিজ্ঞানে রক্ত পরীক্ষা বেশ প্রভাবশালী পরীক্ষা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত হয়। ডাক্তারগণ রক্তের গ্রুপ নির্ণয়ের মাধ্যমে নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে ১৯০৭ সালে সর্বপ্রথম এক মুমূর্ষু রোগীর সফল রক্ত সঞ্চালন করতে সক্ষম হলেন। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় দশ হাজার সৈনিকের চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছিল।
আবিষ্কার:
মানুষের রক্তের গ্রুপ নিয়ে তার অধ্যয়ন ছাড়াও, ল্যান্ডস্টেইনার বিজ্ঞানে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন । তিনি এবং রোমানিয়ান ব্যাক্টেরিওলজিস্ট কনস্ট্যান্টিন লেভাদিতি আবিষ্কার করেন যে এক প্রকার অণুজীব পোলিওমাইলাইটিসের জন্য দায়ী, যা পোলিও ভ্যাকসিনের বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে । ল্যান্ডস্টেইনার সিফিলিসের জন্য দায়ী অণুজীব শনাক্ত করতেও সাহায্য করেছিল । যাই হোক, তিনি তাঁর তদন্তকৃত সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ বলে মনে করতেন “ অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি মিথস্ক্রিয়া “ , যা তিনি প্রাথমিকভাবে নিউ ইয়র্ক সিটির রকফেলার ইনস্টিটিউটে (বর্তমানে রকফেলার ইউনিভার্সিটি বলা হয়) পরিচালনা করেছিলেন (১৯২২-৪৩)। এই গবেষণায় ল্যান্ডস্টেইনার হ্যাপটেন নামক ছোট জৈব অণু ব্যবহার করেছিলেন — যেটি শুধুমাত্র প্রোটিনের মতো বৃহত্তর অণুর সাথে মিলিত হলেই অ্যান্টিবডি উৎপাদনকে উদ্দীপিত করে — একটি অণুর গঠনে একটি ছোট পরিবর্তন কীভাবে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে বিরাট পরিবর্তন ঘটাতে পারে তা প্রদর্শন করার লক্ষ্যে। ল্যান্ডস্টেইনার তাঁর কাজের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছেন “দ্য স্পেসিফিসিটি অফ সেরোলজিক্যাল রিঅ্যাকশন (১৯৩৬)” বই -এ, একটি ক্লাসিক পাঠ্য যা ইমিউনোকেমিস্ট্রির ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিল।
নোবেল পুরস্কার:
ল্যান্ডস্টেইনার প্যাথলজিকাল অ্যানাটমি, হিস্টোলজি এবং ইমিউনোলজি সকল ক্ষেত্রেই অসংখ্য অবদান রেখেছেন, যার সবকটিই আমাদের জানান দেয় যে, শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ এবং বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর সূক্ষ্ম যত্নই নয়, তাঁর জৈবিক বোঝাপড়াও ছিল। কিন্তু তাঁর নাম নিঃসন্দেহে ১৯০১ সালে রক্তের গ্রুপগুলির উপর অসামান্য কাজের জন্য সর্বদা সম্মানিত হবে, যার জন্য তাঁকে ১৯৩০ সালে ফিজিওলজি বা মেডিসিনের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
মৃত্যু:
১৯৪৩ সালের ২৬শে জুন বৈজ্ঞানিক বিশ্ব তার গভীর ক্ষমতার এক অসাধারণ বহুমুখী প্রতিভাকে হারিয়ে ফেলে। কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার,তাঁর পরীক্ষাগারেই ২৪শে জুন হৃদরোগে আক্রান্ত হন, এবং তার দুইদিন পরেই পরীক্ষাগারের হাসপাতালে মারা যান। তাঁর জীবনের একটি বৃহত্তর অংশ বৈজ্ঞানিক কাজে নিবেদিত ছিল, যা একটি অবিনশ্বর স্মৃতিস্তম্ভ হিসাবে চিরকাল রয়ে যাবে।
#cuss
#Death_of_Karl_Landsteiner
References:
1.https://www.nobelprize.org/prizes/medicine/1930/landsteiner/biographical/
2.https://roar.media/bangla/main/biography/karl-landsteiner-the-father-of-blood-grouping
3.https://www.britannica.com/biography/Karl-Landsteine
4.https://journals.aai.org/jimmunol/article-abstract/48/1/vi/62957/Karl-Landsteiner-1868-1943?redirectedFrom=fulltext
Content Credit :
✏️ Written by:
Boishakhi Akter
General Member
Team : Ancient Heroes
Department of Soil Science
Session : 2020-21
Poster Credit :
Raisa Nuzhat
Assistant IT Secretary
Department Of Computer Science and Engineering
Session : 2019-20