আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত “বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষা” শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পাদনা প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান অধিকারী জান্নাতুল ফেরদৌস মীম এর লেখনী প্রকাশ
????আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত “বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষা” শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পাদনা প্রতিযোগিতায় ২য় স্থান অধিকারী জান্নাতুল ফেরদৌস মীম এর লেখনী প্রকাশ????
????”বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষা”????
☘️আচ্ছা, খুব সাধারণভাবে আমরা ভাষা বলতে কি বুঝি? ভাব প্রকাশের মাধ্যম এক কথায়,এই তো? তাহলে ভাষা আর মাতৃভাষার মধ্যে পার্থক্য আসলে কোন জায়গায়?
⭐আমরা সবচেয়ে সাবলীলভাবে যে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি,পড়তে পারি,লিখতে পারি সেটাই হলো মাতৃভাষা।এই যে “সাবলীল” শব্দটি, এটিই মূলত ভাষা আর মাতৃভাষার মধ্যকার মূল পার্থক্য। আমাদের আধো আধো বুলি ফুটার সময় থেকেই আমরা মায়ের মুখে এই ভাষা শুনতে পাই বলে এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বোধগম্য ও সাবলীল হয়।
????আমরা অনেকেই বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি,উর্দু, হিন্দিসহ আরও অনেক ভাষাই জানি।বিশেষ করে একদম শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই বাংলার পাশাপাশি সমান গুরুত্বে ইংরেজির হাতেখড়ি দেয়া হয়ে থাকে আমাদের দেশে কিন্তু তবুও কোথায় যেনো আমাদের জড়তা থেকেই যায়।ইংরেজিতে বক্তব্য দেয়া অথবা ইংরেজি কোনো প্রবন্ধ পড়া এবং বুঝার ক্ষেত্রে আমাদের খানিকটা ঝামেলা পোহাতে হয়।অথচ একই ব্যাপারটা যখন আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ক্ষেত্রে আসে তখন আমরা বেশ পটু।
????বিজ্ঞানের যাবতীয় নথিপত্র বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পাওয়া যায় এবং তার সবটাই ইংরেজিতে।নথিপত্র ইংরেজিতে হওয়ায় গুটিকয়েক শিক্ষার্থী ব্যতীত বেশিরভাগ সবারই কম বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়।প্রথমত, অনেক শব্দই আমাদের বোধগম্য হয় না।তাই বার বার পড়ার মাঝখানে ইংরেজি অভিধানে চোখ বুলাতে হয়,যা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটানোর একটি বিশেষ কারণ। দ্বিতীয়ত,পড়ে বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগে।তৃতীয়ত,অল্প পড়তেই বিরক্তি চলে আসে,ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলি।চতুর্থত,একটি জিনিস ভালভাবে বুঝতে বেশ কয়েকবার করে পড়তে হয়।সর্বশেষ এবং পঞ্চম কারণ হিসেবে বলা যায়,ক্লান্তিকর এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার মাতৃভাষার তুলনায়।
✨বিজ্ঞানের ছাত্র বা ছাত্রী হিসেবে আমাদের জীবনে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার শেষ নেই।এই উচ্চশিক্ষার পথ সহজ হওয়ার জন্য আমাদের সকলেরই অন্তত একটি বা দুইটি বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়া বেশ জরুরি। আর এই গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশনার প্রথম শর্তই হলো সেই গবেষণার বিষয়ের পূর্ববর্তী সকল প্রবন্ধ বা নথিপত্র মোটামুটি পড়ে তথ্য সংগ্রহ করা, যার পুরোটাই বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ইংরেজিতে দেয়া থাকে।এই বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা এবং নথিপত্রগুলো যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় হতো তাহলে ব্যাপারটা আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য কি চমকপ্রদ একটি ব্যাপার হতো ভাবা যায়!
আমরা যদি বাংলা পত্রিকা ও ইংরেজি পত্রিকার পাঠকের পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলেই দেখতে পাই বাংলা পত্রিকার পাঠকের সংখ্যার তুলনায় ইংরেজি পত্রিকার পাঠকের সংখ্যা বেশ নগন্য। এই ব্যাপারটা নিশ্চয়ই বিজ্ঞানভিত্তিক নথিপত্র পড়ার ক্ষেত্রেও একই।এই নথিপত্রগুলো যদি বাংলায় হতো তাহলে হয়তো উচ্চশিক্ষার জন্য আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা লক্ষনীয় হারে বেড়ে যেতো,যা আমাদের দেশকে উন্নত রাষ্ট্র বানানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে বেশ সহায়তা করতে পারতো।
☘️আমরা যদি চীন, জাপান, কোরিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলেই দেখতে পাব তাদের সবধরনের শিক্ষাক্রম বা কার্যপদ্ধতি সব কিছুই তাদের মাতৃভাষায় চলছে।এটি খুব সম্ভবত তাদের উন্নয়নের পিছনের সুপ্তকাঠি।মাতৃভাষার নেপথ্যে আসলেই কি কি সুবিধা পাওয়া যায়,তা একটু চিন্তা করলেই ধরতে পারা যায়।একজন শিক্ষার্থী যদি বিজ্ঞানভিত্তিক নথিপত্রগুলো তার মাতৃভাষায় পায় তাহলে একদিকে তার যেমন বুঝতে সহজ ও তাড়াতাড়ি হবে অপরদিকে খুব সহজেই সেই বিষয়ে সমালোচনামূলক ভাবনা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।এছাড়াও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে,এমনকি এটি দ্বিতীয় ভাষা শিখা এবং বুঝার ক্ষেত্রেও অবদান রাখে।বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা বাসায় যে ভাষা ব্যবহার করছে তা দ্রুত এবং দক্ষতার সাথে প্রয়োগ করতে পারে।
????তবে আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক নথিপত্রগুলো নিজেদের ভাষায় প্রকাশের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় নি।বোধকরি ব্যাপারটা একটু কঠিন, তাই।কিন্তু তাই বলে কি একেবারেই অসম্ভব? উত্তর হবে “না”।
????কেমিকৌশল, যন্ত্রকৌশল, কম্পিউটারকৌশল বা চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক নথিপত্রগুলো চাইলেই রাতারাতি বাংলায় সম্পাদনা সম্ভব নয়।তবে এই ব্যাপারে আমাদের শিক্ষকরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে ব্যাপারটা সহজ হতো।যাই হোক, যারা মনে করেন উচ্চশিক্ষার নথিপত্র প্রনয়ণ বেশ কঠিন বা অসম্ভব তারা চাইলেই বাস্তব কিছু উদাহরণ দেখতে পারেন, যা প্রমাণ করে এটি অসম্ভব কিছু নয় বরং প্রবল ইচ্ছেশক্তিই এখানে প্রধান ভূমিকা রাখে।যেমন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণার কথা বলতে গেলেই অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের নাম এসে যায়। যারা ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব কিংবা ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির শিক্ষার্থী তারা কোনো দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই আবদুল করিম স্যারের বাংলার ইতিহাস (সুলতানি ও মোগল আমল) কিংবা একেএম শাহনাওয়াজ স্যারের বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস, ভারত উপমহাদেশের ও আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের কথা বলতে পারেন।অধ্যাপক একেএম ইয়াকুব আলীর বইগুলো পড়লে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শিক্ষার্থীদের অন্য কোনো নথিপত্র না পড়লেও চলে। উপরে উদাহরণ হিসেবে দেয়া সব কয়জন শ্রদ্ধেয় লেখক এবং শিক্ষকরা ব্যতীত আরও অনেক শিক্ষক রয়েছেন যারা উচ্চশিক্ষাকে মাতৃভাষায় প্রদানের জন্য বা সহজ করার জন্য নথিপত্র অথবা বইগুলোকে বাংলায় রচনা করেছেন।তবে এখন পর্যন্ত দেয়া সব উদাহরণ মানবিক বিভাগের। তবে কি বিজ্ঞান বিভাগের এমন কেউ নেই? উত্তরটি প্রায় “হ্যাঁ ” এর কাছাকাছি। বিজ্ঞান বিভাগে হাতে গুনা দুয়েকজন এর বেশি খুজে পাওয়া বেশ মুশকিল।এই গুটিকয়েকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন বিজ্ঞান লেখক ও বুয়েটের তড়িৎকৌশলের শিক্ষক ফারসীম মান্নান, যিনি মোহাম্মদী মার্কিন মুলুকের নামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জন করার পরেও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন এই প্রজন্মকে মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞান শেখাতে।
????সর্বোপরি বিজ্ঞানের নথিপত্রে যদি আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে প্রয়োগ করা যায় তাহলে হয়তো দেশজুড়ে আরও অনেক অনেক ফারসীম মান্নান স্যার তৈরী হবেন।সুতরাং বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষার গুরুত্ব শুধু অনুধাবন করলেই চলবে না বরং আমাদের সামনে থাকা বিভিন্ন সম্মানিত অধ্যাপক, লেখকরা যারা এসব নিয়ে কাজ করছেন তাদের উদাহরণকে সামনে রেখে এটির বাস্তবায়ন সম্ভব করতে আমরা সকলেই বদ্ধ পরিকর হবো।মাতৃভাষা দিবসে এই প্রয়াসই হোক আমাদের সকলের।