আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত “বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষা” শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পাদনা প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকারী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন এর লেখনী প্রকাশ
????আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত “বিজ্ঞানের নথিপত্রে মাতৃভাষা” শীর্ষক প্রবন্ধ সম্পাদনা প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকারী মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন এর লেখনী প্রকাশ????
????বিজ্ঞানের নথিপত্রে বাংলার অবস্থান: সন্তোষজনক?
✨করুণ সত্য
দুঃখিত, শুরুটা হতাশার কথা দিয়ে শুরু করলাম বলে। আমি এবং আমরা স্বাধীনতার পঞ্চাশটা বছর পেরিয়ে এসেছি। ভাবছি ভিন্ন ভাষার হাওয়ায় চড়ে আমরা তর তর করে সামনে এগিয়ে চলেছি জ্ঞান অন্বেষণে। আমাদের দুবেলার পানীয় হলো এক গৌরব-ঐতিহ্য-সুমিষ্ট ভাষার সাথে ভিনদেশি কিছু আধভাঙ্গা শব্দের মিশ্রণ। ভয় নেই, আমি তথাকথিত টকশো বক্তার মতো সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে বাংলার অপব্যবহার নিয়ে বুলি শুনাতে চাই না৷ এসব বুলির বুদবুদ একুশ তারিখ আপনি পত্রিকা কিংবা টেলিভিশন খুললেই শুনতে পাবেন৷ তাই এসব অহেতুক আলোচনা ফেলে প্রাণরসায়রণের এক ক্ষুদ্র প্রাণ বরং বিজ্ঞানের নথিপত্রেই ফিরে আসি। কিন্তু ফিরে আসতে চেয়েও মুশকিল, আতশি কাচে খুঁজেও বাংলা ভাষায় উল্লেখযোগ্য কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল বা দৈনিক বিজ্ঞান পত্রিকা খুঁজে পেলাম না। অথচ চীন, রাশিয়া, জাপান, ইরানের মতো দেশগুলোর নিজস্ব ভাষায় বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল রয়েছে৷ কিছু নামমাত্র অনলাইন পোর্টাল আমাদেরও তো আছে, তবে তারা বিজ্ঞানকে ছড়িয়ে দেবার পরিবর্তে বিজ্ঞান বেঁচায় সিদ্ধহস্ত৷
☘️জ্ঞানকে বিজ্ঞানের মতো করে অনুভব করতে, শিক্ষার্থীর মাঝে সুচিন্তার মহীরুহ বপন করতে বিজ্ঞান বোঝার প্রথম ও প্রধান ভাষা হতে হবে তার মায়ের ভাষা, যে ভাষা বায়ান্নর এক ফাল্গুনের দিনে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিলো রক্তস্নানে৷ সেটা এতোদিনেও হয়নি। আজ তাই বিরুদ্ধ আয়োজনের কাছে জিজ্ঞাসা, বিজ্ঞান কাদের জন্য? বিজ্ঞান কি কেবল ভবানীপ্রসাদ মজুমদারের সাথে দেখা হওয়া দিদিটার ছেলের জন্য? যার বাংলাটা ঠিক আসে না? না, নতুনকে জানার অধিকার সবার। বিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট এবং বিজ্ঞান বহির্ভূত উভয় শ্রেণির । বিজ্ঞান বহির্ভূত শব্দটাই এখানে ত্রুটিপূর্ণ। বিজ্ঞান যেহেতু সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য কাজ করে, একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষের বিজ্ঞান নিয়ে জানার যতোটা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, একজন স্বল্পশিক্ষিত মানুষের মাঝে কোনো গবেষণাকাজের বার্তা তার বোধগম্য উপায়ে জানানোরও প্রয়োজন রয়েছে৷ অন্যথায় সত্য জানার বিপরীতে গুজবের গুহায় হারিয়ে যেতে পারেন তারা৷ আর তাই চিলের কান নিয়ে যাওয়া ঠেকানোর একমাত্র উপায় হতে পারে বিজ্ঞানকে মায়ের ভাষা দিয়ে জানা। বাস্তবতা হলো, এই জায়গাতেই আমরা জাতি ও রাষ্ট্র হিসেবে পিছিয়ে আছি৷ আমাদের প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বইগুলো এ-প্লাস পাওয়ার কবিরাজি চিকিৎসা হতে পেরেছে বটে, বিজ্ঞান বোঝার মাধ্যম হতে পারেনি৷ অমর একুশে বইমেলায় চার হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয় বটে, কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক বই শ’খানেক ছাড়ায় না৷ জাতি হিসেবে এই বিজ্ঞানবিমুখতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ বিজ্ঞান শেখার পথগুলোকে আমরা নিজের ভাষায় সহজলভ্য না করে অন্য ভাষার বেড়াজালে আটকে ফেলেছি। একজন সাধারণ মানুষের কাছে গবেষক তার গবেষণার বিষয়বস্তু বাংলায় তুলে ধরবেন যতোটা সাবলীল ভাবে, ইংরেজিতে সেটা শতভাগ সম্ভব নাও হতে পারে৷ প্রতিটা গবেষণার নৈতিক দায়িত্ব তা যেই শ্রেণীর মানুষের কল্যাণের বয়ে আনবে সেই শ্রেণীর মানুষের বোধগম্য ভাষায় তার কাছে তুলে ধরা। মাতৃভাষা ছাড়া আর অন্য কোনো ভাষায় এতোটা মধুরভাবে তা তুলে ধরা সম্ভব?
????আশার প্রদীপ
আমাদের দেশে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সংস্কৃতি প্রসিদ্ধ না হওয়া সত্ত্বেও অনেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী বা গবেষকের জন্মস্থান এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের দেশটি৷ জগদীশ চন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জামাল নজরুল ইসলাম, মেঘনাদ সাহা, শুভ রায়, কুদরাত-এ-খুদা, মাকসুদুল আলম প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ মানবকল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে অবদান রাখেন। জগদীশ চন্দ্র বসু সেই ১৯০২ সালে দেখান উদ্ভিদের প্রাণ আছে, উদ্ভিদ বিদ্যুত প্রবাহে সাড়া প্রদান করে। নক্ষত্রের বর্ণালী বিশ্লেষণে মেঘনাদ সাহার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। সত্যেন্দ্রনাথ বসু আবিষ্কার করেন হিগস-বোসন কণা। আইন্সটাইনের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করা সত্যেন্দ্রনাথ বসু কেবল বিজ্ঞানীই ছিলেন না, তিনি নির্দ্বিধায় মাতৃভাষা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার একজন প্রবাদ পুরুষ ছিলেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে শিক্ষকতার সময় বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার উপর তিনি গুরুত্বারোপ করেছেন৷ অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মতো বিজ্ঞানী দেশে ফিরে আসেন একটি বিজ্ঞানমনস্ক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে৷ তাকে নিয়ে স্টিফেন হকিং মন্তব্য করেছিলেন, ‘সে সেরা, আমি তার কাছে কিছুই না’। তার অনেক গ্রন্থ পৃথিবীর প্রায় ১০০ টি বিশ্ববিদ্যালের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত। তার লেখা ‘দ্যা আলটিমেট ফেইট অব দ্যা ইউনিভার্স’ এবং ‘কৃষ্ণবিবর’ বই দুটো বাংলা ভাষায় অনুদিত হয়েছে৷ এছাড়াও কৃত্রিম কিডনী আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দেওয়া শুভ রায়ও বাংলাদেশের সন্তান।
????বর্তমানে অনেক তরুণ গবেষক বিজ্ঞানের নানান বিষয় নিয়ে বাংলা ভাষায় দারুণ সব বই লিখছেন৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: চমক হাসানের গল্পে গল্পে জেনেটিক্স, যুক্তিফাঁদে ফড়িং, রাগিব হাসানের গবেষণার হাতেখড়ি, বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা, মুস্তাক ইবনে আইয়ূবের জিন মন ভালোবাসা ইত্যাদি৷ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্টিফিক সোসাইটির মতো সংগঠনগুলোও মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সংস্কৃতির প্রসারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক দৈনিক কোনো পত্রিকা না থাকলেও প্রকাশিত হচ্ছে বিজ্ঞানচিন্তার মতো মাসিক সাময়িকী। এইসবই আমাদের আশার আলো দেখায়, বিজ্ঞানকে মুখস্থবিদ্যার গণ্ডিতে না ফেলে আনন্দের সাথে গভীরভাবে উপলব্ধি করার প্রেরণা যোগায়৷ এমন উদ্যোগ কিংবা আগ্রহ হয়তো গুটিকয়েক, কিন্তু বিন্দু বিন্দু জলেই একদিন হবে সাফল্যের মহাসমুদ্র।
????করণীয়
ইংরেজির বেড়াজালে বেঁধে না ফেলে বিজ্ঞানশিক্ষার্থীদের অবশ্যই বাংলায় বলার সুযোগ দিতে হবে৷ বাংলা ও ইংরেজির যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানকে উপলব্ধি করতে না পারলে আদতে এই বিজ্ঞানশিক্ষার কোনো দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য থাকবে না৷ তবে বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটাতে গিয়ে বিজ্ঞানের সব শব্দকে বাংলায় রূপান্তরের প্রয়োজন নেই৷ মাইটোকন্ড্রিয়ার বদলে শক্তিঘর, নিউক্লিয়াসের বদলে কেন্দ্রিকা, চেয়ারের বদলে কেদারা শব্দের ব্যবহার শ্রোতার জন্য বিজ্ঞানের ভাষা বোধগম্য করার বদলে দূরহ করে ফেলবে। তাই কিছু শব্দের পারিভাষিক বাংলা শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তে প্রচলিত শব্দের ব্যবহারই বিজ্ঞানশিক্ষাকে আরো আকর্ষণীয় করবে৷ মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য নিয়মিত বাংলায় বিজ্ঞান বক্তৃতা, সমসাময়িক বিজ্ঞান সম্পর্কিত বিষয়ে সেমিনার বা আলোচনা সভার আয়োজন করলে বিজ্ঞানের প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে। বিজ্ঞানের নানান সব মজার মজার পরিক্ষা ও প্রজেক্ট নিয়ে নিয়মিত বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করতে হবে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানসাময়িকী প্রকাশের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞানকে আরো সহজভাবে, ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপনের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে৷
????এই ছোট ছোট উদ্যোগকে যতো বেশি প্রসার ঘটানো সম্ভব ততোই বিজ্ঞানকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। আর সবার মাঝে মাতৃভাষায় বিজ্ঞানের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পারলেই সার্থক হবে ভাষার প্রয়োগ, দেশ এগিয়ে যাবে, বৃথা যাবে না রফিক, জব্বার, বরকতদের রক্ত।
মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন বাপ্পী
প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।