ইন্টারনেটের এক রহস্যময় জগৎ: ডার্কওয়েব
কিছু খুঁজছেন কি? ইন্টারনেটে সার্চ দিলেই হয়!
তবে জেনে বিস্মিত হবেন যে- এই ইন্টারনেটেরই বড় একটি অংশ রয়ে গেছে সাধারণ লোকচক্ষুর আড়ালে। ইন্টারনেটের যে দুনিয়ায় জনসাধারণের অবাধ প্রবেশ তাকে বলা হয় সারফেস ওয়েব। এটি সম্পূর্ণ ইন্টারনেটের মাত্র ১%। অন্যদিকে বলা হয় যে ইন্টারনেটের সামগ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থার ৯৮% ই সেই ডিপ ওয়েবে লুকায়িত, যা প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনে খুঁজে পাওয়া যায় না। ডিপ ওয়েবের একাংশ- যেখানে কৌশলে প্রবেশ করা যায় তা ডার্ক ওয়েব নামে পরিচিত। ডার্ক ওয়েব – ডার্কনেটও বলা হয়।
ডার্ক ওয়েব
ইন্টারনেটের এক বিশাল পরিমাণ ডেটা আসলে সার্চ ইঞ্জিন গুলো দেখতেই পায় না। এমনকি সে অংশে সাধারণ ইউআরএল বা ডট কম ডোমেইন লিখে প্রবেশ করাও যায় না, দরকার হয় বিশেষ ব্রাউজারের। একেই বলে ডার্কওয়েব।
মোটকথা ইন্টারনেটের যে অংশে আমাদের সরাসরি কোন অ্যাক্সেস নেই এবং সার্চ ইঞ্জিন গুলোও সেসকল ডেটাকে ইনডেক্স করতে পারে না বা খুঁজে পায় না, শুধুমাত্র বিশেষ ওয়েব ব্রাউজার (সফটওয়্যার) ব্যবহার করে এতে প্রবেশ করা যায় তাকে ডার্কওয়েব বলে।
যদি বলা হয়-ইন্টারনেটের এই লুকায়িত ডাটা গুলো কতোটা বিশাল?
জবাবে বলা যায়- তা সারফেস ওয়েবের চেয়ে হাজার গুন বিশাল।
মূলত, নিজেদের মধ্যে একান্তে যোগাযোগের জন্য বিশেষ গোষ্ঠীর তৈরি করেছে এই ডার্ক ওয়েব। ধীরে ধীরে গোপনীয়তার সুরক্ষায় এখানে আনাগোনা হতে শুরু করে অপরাধীদের। বেশিরভাগই এখানে প্রবেশ করে নিজেকে লুকিয়ে।
ডিপ ওয়েব বনাম ডার্ক ওয়েব
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ডার্ক ওয়েবের সাথে ডিপ ওয়েবের সম্পর্ক কতোটুকু? সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করে যে তথ্য বা ওয়েবসাইট আপনি খুঁজে পাবেন না তাই ডিপ ওয়েবের আওতায় আসে, যেখানে সহজে বা কোন ভাবেই প্রবেশ করা যায় না, আর ডার্ক ওয়েবও গোপনীয়। তাই অনেকে ডার্ক ওয়েব কে ডিপ ওয়েব এর সাথে মিলিয়ে ফেলে, কিন্তু দুটো আলাদা। মূলত ডিপ ওয়েবেরই ছোট্ট একটি অংশ নিয়ে ডার্ক ওয়েব গঠিত যেখানে নির্দিষ্ট ব্রাউজার ব্যবহার করে প্রবেশ সম্ভব।
কী আছে এই ডার্কনেটে?
কী নেই এখানে! যা চাইবেন, সবই আছে ডার্ক নেটে। শুধু খুঁজে নেয়ার পদ্ধতিটা জানতে হবে সঠিকভাবে।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর মতো ডার্ক ওয়েবেও আছে বিভিন্ন রকম ওয়েবসাইট। ডার্ক ওয়েবেও আছে মেইল, ব্লগ এবং সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, উইকিপিডিয়া ইত্যাদির আলাদা ভার্সনও আছে ডার্ক ওয়েবের জন্য বাইরের দুনিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত অনেক সাইট ও রয়েছে এখানে। আছে বিভিন্ন অবৈধ ওয়েবসাইট, নিজস্ব পেমেন্ট সিস্টেম।
ডার্ক ওয়েব কেনো?
ডার্ক ওয়েবে ব্যক্তিগত তথ্য যেমন কারো ব্যাংক একাউন্টের তথ্য, ব্যক্তিগত ইমেইল ইত্যাদি থেকে শুরু করে বড় কর্পোরেশন বা সরকারের অন্তর্গত মেডিকেল রেকর্ড, সরকারি প্রতিবেদন, দলিলপত্রাদি, আর্থিক রেকর্ড যা সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয় এমন তথ্যাদি সংরক্ষণ করা হয়। এসকল রেকর্ড সুরক্ষিত ও গোপন রাখার লক্ষ্যে ডার্ক ওয়েবে রাখা হয় যাতে প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনগুলি তা সূচিবদ্ধ করতে না পারে।
ডার্ক নেট ব্রাউজার
প্রচলিত ব্রাউজার ও সার্চ ইঞ্জিন ডার্ক ওয়েবের অ্যাকসেস নিতে পারে না। এর জন্য রয়েছে বিশেষ ব্রাউজার ও পৃথক সার্চ ইঞ্জিন। ডার্কনেটে প্রবেশের জন্য সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্রাউজার হলো TOR (“The Onion Routing” project)। এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশান প্রযুক্তির মাধ্যমে টর- ব্যবহারকারীর পরিচয় গোপনের সুরক্ষা প্রদান করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় হওয়ার নিশ্চয়তা দেয়। উচ্চ স্তরের এনক্রিপশনের কারণে হোস্ট ওয়েবসাইট ব্যবহারকারীর আইপি এবং লোকেশান ট্র্যাক করতে সক্ষম হয় না। ব্যবহারকারীও হোস্টের ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়। এইভাবেই ডার্কনেটে ব্যবহারকারীদের মধ্যকার যোগাযোগ যেমন কথা বলা, ব্লগিং এবং ফাইল আদান প্রদান অত্যন্ত নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার সাথে সম্পন্ন হয়। টর এর মতোই আরেকটি ডার্ক ওয়েব ব্রাউজার হলো I2P (“Invisible Internet Project”)। তবে টর ই সবচেয়ে জনপ্রিয়।

টর তৈরির প্রেক্ষাপট
ডার্ক ওয়েবের যেকোনো অংশে অ্যাক্সেস করার জন্য বর্তমানে ব্রাউজার হিসাবে TOR ব্যবহৃত হলেও, এটি মূলত মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অনলাইন যোগাযোগ রক্ষার্থে সহায়তা করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। মার্কিন নৌবাহিনী তৈরী করেছিল এটি। তৈরির পেছনে কারণ ছিল এই যে-যুদ্ধের সময় সামরিক তথ্য আদান প্রদানের সব পন্থা নষ্ট হয়ে গেলে তারা যাতে সাধারণ ইন্টারনেটের মাধ্যমে সুরক্ষিত ভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে ।
টর এর ব্যবহার
টর এর এনক্রিপশন পদ্ধতি কাজে লাগিয়েই ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতে হয় যেটা আমাদের তথাকথিত নর্মাল ব্রাউজার পারে না। আর তাই, বিশ্বজুড়ে রয়েছে টরের এমন অনেক আলোচিত ব্যবহার যা এর ডেটা এনক্রিপশান ম্যাথড এর জন্যই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চীন কিংবা ইরানের কথাই ধরা যাক। এসব দেশে ইন্টারনেট ব্যবহার কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে অনেকে টর ব্যবহার করেন। জার্নালিস্টরা তাদের সোর্সের সঙ্গে সুরক্ষিত ভাবে তথ্য আদান-প্রদান করতে ব্যবহার করেন টর। এছাড়াও যেকোনো অপরাধ চক্র অথবা সাইবার ক্রিমিনালদের পাকড়াও করতে গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক টর এর সুকৌশলী ব্যবহার তো রয়েছেই।

ডার্ক ওয়েব পেমেন্ট সিস্টেম
ডার্ক ওয়েবে লেনদেনের জন্য বিটকয়েন এবং মনেরো নামক মুদ্রা ব্যবহার করা হয়। ইন্টারনেট অবলম্বনে ১ বিটকয়েন = ৩,৪১,৮১৩ টাকা বলে জানা যায়।
ডার্ক ওয়েব এর অন্ধকার
নিজের পরিচয় গোপন রেখে ইন্টারনেটে অবাধে বিচরণ করা যায় বলে দূর্ভাগ্যবশত, অপরাধমূলক কর্মকান্ডের জন্য এক স্বর্গ হয়ে উঠেছে এই ডার্ক ওয়েব।
কিছু অসাধু ব্যক্তি ডার্ক ওয়েব এ গুপ্ত ওয়েবসাইট খুলে তাতে অনৈতিক এবং অসামাজিক কার্যকলাপ পরিচালনা করে থাকে। যেমন:
- অবৈধ ড্রাগ কেনাবেচা
- অবৈধ হাতিয়ার কেনাবেচা
- কাউকে খুন করার জন্য হিটম্যান ভাড়া করা
- এমনকি নির্দিষ্ট কাজের জন্য এখানে সাইবার ক্রিমিন্যাল বা ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার ভাড়াটেও কাজ করে।
এছাড়াও জঙ্গি এবং উগ্রপন্থীরা ফেসবুকের মত ওয়েবসাইট বানিয়ে তাতে তথ্য আদান প্রদান করে। হামলা বা নাশকতার ছক বানায়। এগুলোও ডার্ক ওয়েবের আওতায় করা হয়।
ডার্ক ওয়েব কি অবৈধ?
মোটেই না! ডার্ক ওয়েবসাইট দ্বারা কোনো অবৈধ কার্যকলাপ হাসিল করা ও তাতে যোগদান অবৈধ। কিন্তু ডার্কওয়েব অবৈধ নয়। বরং ডার্ক ওয়েবের সাথে অপরাধীচক্রের ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকায় এদের খুঁজে পেতে ছদ্মবেশী গোয়েন্দা পুলিশের জন্য ওয়েবটি অনন্য ভূমিকা রাখে। যদিও নানান অবৈধ ও অনৈতিক লেনদেনের জন্য দায়ী কিন্তু কারো ব্যক্তিস্বার্থ এবং গোপনীয়তা রক্ষায় এই ডার্ক ওয়েবই অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে পারে। নিজের গোপনীয়তা রক্ষার্থে ডার্ক ওয়েব সত্যিই এক উৎকৃষ্ট জায়গা। তাই বলা যায়-ডার্ক ওয়েব অবশ্যই বৈধ, যদি এর ক্ষতিকর দিকের কথা বাদ দেওয়া যায়।
টরে ট্র্যাকড হতে পারেন?
টর এমনই এক ব্রাউজার যেটা প্রতিনিয়ত আসল এড্রেস লুকিয়ে ফেলে। ফলে ডার্ক ওয়েবে কারো লোকেশন ট্র্যাক করাটা খুবই ঝামেলার কাজ হয়ে দাঁড়ায়।তবে এ কথাও সত্যি যে-টর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করা,কারো পরিচয় ট্র্যাক করাকে যদিও কঠিন করে তোলে কিন্ত তা অসম্ভব কিছু নয়। তাই ট্র্যাকড হওয়া এড়াতে কোনও গোপনীয় পরিসেবা যেমন ভিপিএন পরিসেবা ব্যবহার করা নিরাপদ। এটি ডেটা এনক্রিপ্ট করতে পারে এবং আইপি অ্যাড্রেসকেও রাখে সুরক্ষিত।
সতর্কীকরণ
তবে টর নিয়ে ডর থাকুক বা নাই থাকুক, ডার্ক ওয়েবে রয়েছে ভীতিকর নানান ওয়েবসাইট। সারফেস ওয়েবে কোনো অনিরাপদ সাইটে প্রবেশ করতে চাইলে ব্রাউজার বাধা দেয়, সতর্ক করে। ডার্ক ওয়েবে কিন্তু এর কোনো বালাই নেই। উপরন্তু অচেনা-অজানা ব্যবহারকারী ও প্রফেশনাল হ্যাকার তো আছেই। তাই, নিজের আগ্রহ থেকেও ডার্ক ওয়েব নিয়ে না ভাবাই বুদ্ধিমানের লক্ষণ। এসএমএস, মেইল কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনো বিদঘুটে ওয়েব ঠিকানা পেলে তাতে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকুন। ইন্টারনেট দুনিয়া রাখুন ভাবনাহীন ও নিরাপদ।
সূত্র :





Written By:
Airin Asfi
Genetic Engineering & Biotechnology
Chittagong University

Poster Credit:
Farhana Sultana Ananna
Computer Science & Engineering
Chittagong University
1 Comment
Hello Hello Hello