এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সানজানা তাবাসসুম নোভার লেখা আর্টিকেল।
#আর্টিকেল_রাইটিং
#জামাল_নজরুল_ইসলাম
এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থান অধিকারী সানজানা তাবাসসুম নোভার লেখা আর্টিকেল।
✨বিশ্বনন্দিত বাঙালি বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম ✨
⭐‘HE IS ONLY GREATEST! I AM NOBODY TO REACH HIS HIGHNESS’. বিশ্বখ্যাত পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম কে নিয়ে স্টিফেন হকিং এই মন্তব্যটি করেছেন। এ পৃথিবীকে জানার অদম্য কৌতুহল ছিল বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলামের।তাঁর এই জ্ঞানচর্চা বিজ্ঞানের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল ধর্ম, অর্থনীতি, দর্শন থেকে শুরু করে সংগীত, সাহিত্য, শিল্পকলা, এমনকি ইতিহাসসহ বিভিন্ন বিভাগে। নানান বিষয়ের বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন তিনি।
????জন্ম ও শিক্ষাঃ
অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন তবে তার শিকড়ের ঠিকানা চট্টগ্রামে। বাবা মুহম্মদ সিরাজুল ইসলাম ছিলেন ঝিনাইদহ জেলার মুনসেফ (বর্তমান সহকারি জজের সমতুল্য)। মা রাহাত আরা বেগম একজন সাহিত্য অনুরাগী লেখিকা গানও গাইতেন বেশ। মা ছিলেন তাঁর জীবনের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি মা কে হারান। বংশগত দিক থেকে ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। তৎকালে ঢাকার নবাব এবং জর্ডানের বাদশার পরিবারের সাথে ছিল ভালো যোগাযোগ। তাদের বাসায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের যাতায়াত ছিলএবং কবির নামের সাথে মিল রেখে তার নাম রাখা হয়েছিল ‘জামাল নজরুল ইসলাম’।বাবার চাকরির সূত্রে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় কলকাতায়। চতুর্থ শ্রেণীর পরে চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের ফলে ডাবল প্রমোশন পেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি নেয়া হয়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত এখানে পড়ালেখা করেন এবং পরবর্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানে লরেন্স কলেজে ভর্তি হন।সেখানে সিনিয়র কেমব্রিজ(ও লেভেল) ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ(এ লেভেল) পাশ করেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান এবং বিএসসি অনার্স সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজে পড়তে যান এবং প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে আবারো স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৫৯ সালে। মাত্র ২০ বছর বয়সে দুইবার বিএসসি এবং এখান থেকেই ১৯৬০ সালে মাস্টার্স ডিগ্রি এবং১৯৬৪ সালে ‘এপ্লায়েড ম্যাথমেটিক্স এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স’ এর উপর পিএইচডি সম্পন্ন করেন।বিজ্ঞানে উচ্চমানের দক্ষতা বা খুব বড় ধরনের অবদান থাকলে ডক্টর অব সায়েন্স (ডিএসসি) প্রদান করা হয়। এ ধরনের ব্যক্তিরা হলেন শিক্ষকদের শিক্ষক, সেরাদের সেরা।১৯৮২ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডিএসসি ডিগ্রিতে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
✏️কর্মজীবনঃ
১৯৬৩-১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ড. ইসলাম পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে। কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমি-তে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭-১৯৭১পর্যন্ত। ১৯৭১-১৯৭২ সাল তিনি কাজ করেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-তে। ১৯৭২-১৯৭৩ সাল ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটিতে সিনিয়র গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩-১৯৭৪পর্যন্ত তিনি ছিলেন লন্ডন কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক।১৯৭৫-১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮-১৯৮৪ পর্যন্ত তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে রিডার পদে উন্নীত হন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে ছিলেন। ১৯৮১ সালে লন্ডনের লাখ টাকার চাকরি এবং উন্নত সুযোগ-সুবিধা ছেড়ে মাত্র ২৮ শত টাকা বেতনের চাকরি নিয়ে চলে আসেন মাতৃভূমি বাংলাদেশে।যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে। এখানে এক বছর অধ্যাপনা করার পর গবেষণার কাজে আবার লন্ডনে ফিরে যান। এরপর ১৯৮৪ সালে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরেন।
????প্রকাশনাঃ
তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘দি আলটিমেট ফেইট অব দি ইউনিভার্স’ যা ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত হয়।বিজ্ঞানী মহলে ব্যাপক সাড়া বইটি অনুদিত হয় ফরাসি, জাপানি, পর্তুর্গিজ ও যুগোস্লাভ ভাষায়।স্টিফেন হকিং এর ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’প্রকাশের ৫ বছর আগেই ড. ইসলাম বইটি লিখেছিলেন। ব্লাকহোল, ওয়ার্ম হোল, সুপারনোভা, কসমিক রেডিয়েশন, প্যারালাল ইউনিভার্স, বাটারফ্লাই ইফেক্ট ইত্যাদি সব জ্যোতি পদার্থবিজ্ঞানীয় ব্যাপারগুলোই দুটো বইতে ছিল কিন্তু তুলনামূলক জামাল নজরুল ইসলামের বইটিকেই বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ অধিক মূল্যায়ন করেছেন।
বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার জন্য এক অনন্য নাম লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি,যার প্রসিডিংসয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করা মানে আক্ষরিক অর্থেই রাজকীয় কাজ। ড.ইসলাম এই প্রসিডিংসয়ে পরপর ছয়টি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ড.ইসলামের ক্ষেত্রে রিকমেন্ডেশন করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ও ফ্রেড হয়েল।গবেষণাপত্রের বিষয় ছিল ‘অন রোটেটিং চার্জড ডাস্ট ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’। সাধারণ আপেক্ষিকতা ও চার্জিত বস্তু নিয়ে করা গবেষণার উপর ভিত্তি করেই লিখেন ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’ নামের বইটি। ১৯৮৫ সালে এটি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।
১৯৮৫ সালে বাংলায় লিখা অন্যতম বই কৃষ্ণবিবর।মহাকাশের এক বিস্ময়, যা সব কিছু টেনে নেয় নিজের গভীরে, এমন কি আলোও। কি করে জন্ম নেয় কৃষ্ণ বিবর? কি তার প্রকৃতি? কৃষ্ণ বিবর কি চিরস্থায়ী? এই সব প্রশ্ন নিয়ে এ বই।আকারে সংক্ষিপ্ত কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি বই।বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের এমন উচ্চমানীয় বই উপহার দিয়েছেন তিনি।এমন একটি বই পাওয়া আসলেই আবেগের ও আনন্দের।
১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় ‘ইনট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি’
স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ ম্যাগাজিনের জানুয়ারি ১৯৭৯ সংখ্যার প্রচ্ছদ। এই সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল জামাল নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ।
অধ্যাপক ইসলাম আরো দুটি বই লিখেছিলেন। ১. অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথমেটিক্যাল ইকনোমিক্স ও ২. কনফাইনমেন্ট অ্যান্ড শ্রোডিংগার ইকুয়েশন ফর গাউস থিওরিস। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইগুলো প্রকাশের প্রক্রিয়া চলছে।
????পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড থিওরিটিক্যাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়। ২০০১ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্যে ২০১১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদকে ভূষিত করা হয়।
????ব্যাক্তিত্বঃ
ব্যক্তি হিসেবে ড. ইসলাম ছিলেন অসাধারণ।বইপড়া ,গানশোনা এবং ছবি আঁকার প্রতি ছিল দারুন ঝোঁক। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে বেশ অনীহা ছিল তার। মাথা খাটিয়ে গণিতের জটিল সব সমস্যার সমাধান করতে ভালবাসতেন। ২০০১ সালে গুজব উঠেছিল পৃথিবী ধ্বংসের, তখন তিনি অংক কষে বলেছিলেন পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছুটে চলে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। বিশ্বমানের সব গবেষণাগারে কাজ করার হাতছানি পেছনে ফেলে ছুটে এসেছেন বাংলাদেশে, গড়ে তুলেছেন বিজ্ঞানচর্চার জন্যে আধুনিক গবেষণাগার। বাংলাদেশের বিজ্ঞান শিক্ষা এবং বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে তুলেছেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিচার্স সেন্টার ফর ম্যাথমেটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স যা, যেটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে দেশের প্রবীণ পদার্থবিজ্ঞানী প্রফেসর এ এম হারুন-অর রশিদ ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এখানে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী, আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্ব সৃষ্টি তাত্ত্বিকদের অবদান স্মরণ করে এ প্রতিষ্ঠানকে প্রফেসর ইসলামের শ্রেষ্ঠ কীর্তি আখ্যা দিয়েছিলেন। এখানে তিনি উচ্চতর গবেষণার ছাত্রদের সহায়তার পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার আয়োজন করেছেন, যাতে অনেক নোবেলজয়ীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের পণ্ডিতজন যোগ দিয়েছেন।তার হাতে গড়া এই ইনস্টিটিউটে গবেষণার সুযোগ পাচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। বাংলাদেশে আধুনিক মানের গবেষণার এই পরিবেশ ধরে রাখার পেছনে মূল অবদান তার।১৯৭১ সালে পড়ালেখা এবং কাজের জন্যে বিদেশে অবস্থান করলেও পরোক্ষভাবে দেশের জন্যে কাজ করেছেন। বিশ্বের নানাপ্রান্তে অসংখ্য চিঠি লিখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি করেছেন।উনি মোবাইল ব্যবহার করতেন না, অন্যদেশের অপারেটর দেশের টাকা নিয়ে যাবে তা মানতে পারেননি।
????বিশ্বের ৭ জন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর নাম বলতে গেলে সে তালিকায় নাকি জামাল নজরুলের নামও চলে আসবে। বিশ্বের বুকে বাংলার গর্ব জামাল নজরুল ইসলাম।
????তথ্যসূত্রঃ
1.https://www.bd-journal.com/other/164243
2.https://obituary.quantummethod.org.bd/detail/307a6080-a0fe-11e2-b5e3-00270e0b2b42
3.https://www.bigganchinta.com
4.https://roar.media/bangla/main/science/jamal-nazrul-islam-a-great-scientist-of-bangladesh
✏️সম্পাদনায়ঃ
Sanjana Tabassum Nova
Session: 2019-2020
Department of Physics