এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী ইশরাত জাহানের লেখা আর্টিকেল।
#আর্টিকেল_রাইটিং
#জামাল_নজরুল_ইসলাম
✨এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অধিকারী ইশরাত জাহানের লেখা আর্টিকেল।
যশ খ্যাতির ঊর্ধ্বে বাঙালি বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. জামাল নজরুল ইসলামের গল্প।
☘️আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় বাংলাদেশকে বিশ্বদরবারে পরিচয় করাতে আপনি কোন বিষয় কিংবা কোন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করবেন? ক্রিকেট প্রেমীরা বলবেন সাকিব আল হাসান, ভ্রমণ প্রেমীরা বলবেন কক্সবাজার, সুন্দরবন ইত্যাদি, গবেষণা প্রেমীরা বলবেন জগদীশ চন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ বোসের কথা, কিন্তু আপনি নির্দ্বিধায় আরও যে একজন বিজ্ঞানীর মাধ্যমে দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন তিনি হল বিজ্ঞানী ড. জামাল নজরুল ইসলাম। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন এমনই একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব যার মৌলিক গবেষণা ও চিন্তা ধারা অবাক করেছে পুরো বিশ্বের বিজ্ঞানীদের। তিনি গবেষণা করেছেন গণিত, তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা, মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, কোয়ান্টাম মেকানিক্স ইত্যাদি নিয়ে। আমরা অনেকেই বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এর A Brief History of Time যা ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে, বইটির কথা শুনেছি, যার কারনে তিনি এত বিখ্যাত। কিন্তু আমরা অনেকেই এটা জানিনা যে তার অনেক আগেই ১৯৮৩ সালেই বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম এ বিষয়ক তার প্রথম গ্রন্থ The Ultimate Fate of The Universe প্রকাশ করে ফেলেছেন। শুধু তাই নয় এই বইটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজ, সার্ব, ক্রোয়েট সহ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং এটি অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড, ক্যালটেকের মত বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচীকর্মে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মহাজগতের অন্তিম পরিনতি কি হবে এটা কি কখনো জানতে ইচ্ছা করেছে? যদি জানতে চান পড়তে পারেন বিখ্যাত এই বইটি (The Ultimate Fate of the Universe) । তাঁর অমায়িক ব্যাক্তিত্ব তাকে যশ খ্যাতি থেকে এতটাই দূরে রেখেছে যে অনেক বাংলাদেশীও এই নামটি সম্পর্কে আজও জানেনা। দেশপ্রেমের অকৃত্রিম উদাহরণ, ডা. জামাল নজরুল ইসলাম, বিলাসবহূল ও আরামপ্রদ জীবনকে পিছনে ফেলে নিজ দেশের কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন বিনা দ্বিধায়। আজ এমনই এক ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হব আমরা।
????অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবার চাকরিসূত্রে ছেলেবেলা কাটে কলকাতা শহরে। এরপর তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের লরেন্স কলেজ থেকে এ লেভেল এবং ও লেভেল পরীক্ষা দেন। লরেন্স কলেজে থাকাকালীন সময়েই তাঁর গণিতের প্রতি ভালোবাসার জন্ম নেয়। জটিল জ্যামিতি কষা ছিল তাঁর প্রিয় শখ। ক্যাল্কুলেটর ব্যাবহার করা পছন্দ করতেন না, যা হিসাব নিকাশ তা নিজ হাতেই করে নিতেন। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে তিনি অনার্স পাশ করেন। তিনি বিশ্বের অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান যেমন ট্রিনিটি কলেজ, ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি, ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় এবং কার্ডিফ ইউনিভার্সিটি থেকে জ্ঞান ও গবেষণার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তিনি কিংস কলেজ লন্ডনে ফলিত গণিতের একজন অনুষদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
????বাংলাদেশের তৎকালীন অতি ক্ষুদ্র গবেষণার ক্ষেত্রগুলো সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে যখন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম বিদেশি উচ্চ বেতন ও উন্নত জীবনকে তুচ্ছ করে ফিরে আসেন বাংলার মাটিতে, সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে চট্টগ্রাম শহরে, যা ছিল তাঁর প্রাণের স্থান। বিদেশী উচ্চবিলাসী জীবনের আকাঙ্খায় বাংলাদেশের সেরা মানের বিজ্ঞানীরা পি আর পাওয়ার জন্য কতই না কসরত করে থাকে, সেখানে এই মানুষটি তীব্রভাবে মেধা পাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন, বিশ্বসেরা বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শ, উচ্চ বেতন, ছেলেমেয়েদের আরামপ্রদ জীবনযাপন সবকিছুকে বাদ দিয়ে তিনি বেছে নিলেন ক্যারিয়ারের কঠিনতম অধ্যায়। তিনি নিজেই একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
????‘স্থায়ীভাবে বিদেশে থাকার চিন্তা আমার কখনোই ছিল না। দেশে ফিরে আসার চিন্তাটা প্রথম থেকেই আমার মধ্যে ছিল, এটার ভিন্নতা ঘটে নি কখনোই। আরেকটা দিক হল, বিদেশে আপনি যতই ভালো থাকুন না কেন, নিজের দেশে নিজের মানুষের মধ্যে আপনার যে গ্রহণযোগ্যতা এবং অবস্থান সেটা বিদেশে কখনোই সম্ভব না’।
ডাঃ. ইসলাম ১৯৮৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগের একজন অনুষদ সদস্য হিসাবে যোগদান করেন। এরপর তিনি সেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার জন্য আরসিএমপিএস – রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস – প্রতিষ্ঠা করেন এবং আমৃত্যু সেখানেই কাজ করেছেন। তার অধীনে অনেক শিক্ষার্থী মাস্টার্স ও পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। সেই শিক্ষার্থীদের ভাষ্যমতে তিনি ছিলেন একজন জ্ঞান পিপাসু ব্যক্তি যিনি নিখুঁত কাজে বিশ্বাসী ছিলেন, বিজ্ঞান মহলের যশ খ্যাতির দিকে তার ঝোঁক ছিলনা বললেই চলে। তার সান্নিধ্য সমৃদ্ধ করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে শত শত মানুষকে। তিনি তার শিক্ষার্থীদের ও চেনা জানা মানুষদের সবসময় দেশের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত করতেন। অভাবী শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের আয়ের অংশ থেকে সাহায্য করতেন। আসলে তার ধ্যান জ্ঞ্যান সব জুড়েই ছিল কিভাবে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ও গবেষণার ক্ষেত্রগুলোকে মানসম্মত করা যায়।
✨ডাঃ. ইসলাম মাতৃভাষায় রসায়ন চর্চা নিয়ে মানুষের মনে যে অবজ্ঞা রয়েছে, তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ছিল অন্যরকম ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। তিনি বিশ্বাস করতেন বাংলা ভাষায় প্রকাশিত বই বা গবেষণা পত্র অনুধাবন করতে কোন সমস্যা হয় না, বরং বাংলা ভাষায় প্রকাশিত গ্রন্থগুলোও সারা বিশ্বে অনায়াসে সমাদৃত হচ্ছে। বাংলার মাটি ও বাঙ্গালির প্রতি তাঁর ভালোবাসার টান আরো প্রকাশ পায় যখন তিনি বিদেশে অবস্থানকালীন সময়েই ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সরকারকে পাক বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেওয়ার আবেদন করে চিঠি লিখেছেন। গবেষণা কর্ম ছাড়াও তিনি বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, শিক্ষার প্রসার, কৃষিভিত্তিক শিল্প সংস্কৃতি গড়ে তুলতে বিভিন্ন কাজ করে গেছেন। শিল্পনীতির ব্যাপারে বিশ্বসংস্থা গুলোর দেওয়া পরামর্শ যে আমাদের কৃ্ষিভিত্তিক দেশের জন্য মোটেই লাভজনক হবেনা তা তিনি বুঝতে পেরে আমাদের দেশের আবহাওয়া এবং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী শিল্পনীতি মেনে চলার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। পাশ্চাত্য সাহায্যের ব্যাপারে তার একটি বিখ্যাত উক্তি আছে –
‘তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালোমন্দ আমাদেরকেই ভাবতে দাও। আমি মনে করি, এটাই সর্বপ্রথম প্রয়োজনীয়।’
২০০১ সালে একটি মজার ঘটনা ঘটে। সারা বিশ্বে একটি গুজব রটে যায় যে মহাবিশ্ব নাকি ধ্বংসের পথে। এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে শুরু হয় তোলপাড়, সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়ে, এ নিয়ে সিনেমাও বানানো হয়েছিল। পরে বিজ্ঞানী জামাল নজরুল বিশ্লেষণ করে আমাদের আশ্বস্ত করেন যে, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না। তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে ‘ক্লাসিক্যাল জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি’, ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথম্যাটিক্যাল কসমোলজি’, ‘দ্য ফার ফিউচার অফ দি ইউনিভার্স’, ‘কৃষ্ণ বিবর’, ‘মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা’, শিল্প সাহিত্য ও সমাজ ইত্যাদি। একটা সময় ছিল যখন ব্ল্যাক হোল নিয়ে শুধুমাত্র বিজ্ঞানীরাই জানত, সাধারণ মানুষের ধরা ছোয়ার বাইরে ছিল এই বিষয়। তখন তিনি ‘কৃষ্ণ বিবর’ বইতে বাংলাতেই এই কঠিন বিষয়ে আলোকপাত করেন। সাধারণ মানুষের মনে বিজ্ঞান চর্চার আগ্রহ জাগিয়ে তুলার তাঁর যে প্রয়াস ছিল তা নিতান্তই বাঙ্গালীদের জন্য ভাগ্যের বিষয়।
প্রচারবিমূখ এই বিজ্ঞানী ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ইন্তেকাল করেন। বাংলার বুকে থাকা একজন কিংবদন্তি, একজন নক্ষত্রকে হারিয়েছি আমরা। নিজের জ্বলজ্বলে ক্যারিয়ারকে তুচ্ছ করে যিনি বাংলাদেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর গবেষণার পথ প্রশস্ত করেছেন, দেশে উন্নতমানের গবেষনার ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়ে গেছেন তাঁর জন্য প্রতিটি বাংলাদেশী তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
রেফারেন্সঃ
1.https://www.thedailystar.net/opinion/tribute/remembering-professor-jamal-nazrul-islam-1557064
2.https://obituary.quantummethod.org.bd/en/detail/307a6080-a0fe-11e2-b5e3-00270e0b2b42/Dr.%20Jamal%20Nazrul%20Islam
3.https://newsviews.media/dr-nazrul-islam/
✏️লেখনিতে:
ইশরাত জাহান
রসায়ন বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।