এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী রোমানা আক্তার নিশাতের লেখা আর্টিকেল
#আর্টিকেল_রাইটিং
#জামাল_নজরুল_ইসলাম
এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের বিজ্ঞান অগ্রযাত্রায় অবদান নিয়ে আর্টিকেল লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারী রোমানা আক্তার নিশাতের লেখা আর্টিকেল
➡️“He is only greatest, I am nobody to reach his highness” – কথাটি বলেছিলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং!না, তিনি এ কথাটি উন্নতবিশ্বে জন্ম নেয়া কোনো নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীকে নিয়ে বলেননি।বরং বলেছিলেন আমাদের দেশেরই একজন সাধারণের বেশে থাকা অসাধারণ বিজ্ঞানী ‘ড.জামাল নজরুল ইসলাম’ কে নিয়ে!কিন্তু আমাদের দেশের এই রত্নটিকে আমরা কয়জনেই বা চিনি?কতজনেই বা জানি যে আমাদের দেশের একজন বিজ্ঞানীর লিখা বই অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড এবং কেমব্রিজের মতো বড় বড় আরও অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যবই হিসেবে স্বীকৃত?এই মহান মানুষটি তৎকালীন লন্ডনের সোয়া লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজ দেশকে ভালোবেসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসিক তিন হাজার টাকা বেতনে শিক্ষকতা করাকেই শ্রেয় বলে ধরে নিয়েছিলেন যে এটাও তো আমাদের অনেকেরই অজানা!আসুন আজ তাহলে জেনে নেয়া যাক, আজীবন লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যাওয়া প্রচারবিমুখ,মহান এই বিজ্ঞানীর কথা!
➡️নাম তাঁর জামাল নজরুল ইসলাম।জন্মেছিলেন ১৯৩৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি।যদিও তার পূর্বপুরুষদের বাস ছিলো চট্টগ্রামে কিন্তু তিনি জন্মেছিলেন তাঁর বাবার কর্মক্ষেত্র ঝিনাইদহে।বংশ মর্যাদায়ও কিন্তু তিনি কিছু কম ছিলেন না!ছিলেন অভিজাত এক পরিবারের সন্তান,যে পরিবারের যোগাযোগ থাকতো ঢাকার নবাব বাড়ির পাশাপাশি জর্ডানের বাদশাহর পরিবারের সাথে!বাবা কলকাতায় বদলি হওয়ার সুবাধে তাঁর শিশুকাল কাটে কলকাতায়!কলকাতায় থাকাকালীন কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে তাঁর পরিবারের সখ্যতা ছিলো অনেক।তাইতো নামটিও তাঁর বাবা-মা রেখেছিলেন কবির নামের সাথে মিল রেখেই!চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত কলকাতায় থেকে তারপর দেশ ভাগ হওয়ায় চলে আসেন চট্টগ্রামে,ভর্তি হন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে!এই স্কুলেরই ভর্তি পরীক্ষায় অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়ে ডাবল প্রমোশন পেয়ে একেবারে ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠে যাওয়ার মতো ঘটনাও তাঁর জীবনে রয়েছে!গণিতের প্রতি বেজায় ঝোঁক ছিলো মানুষটার।নিজে নিজেই অংক কষতেন সময় অসময়ে!তারপর একে একে পাকিস্তানের লরেন্স স্কুল থেকে লরেন্স কলেজ,কলেজের পরে সিনিয়র ক্যামব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র ক্যামব্রিজ ও পাশ করে ফেলেন তিনি।হায়ার সিনিয়র ক্যামব্রিজে গণিত খুব কঠিন হওয়ায় কেউই নিতে চাইতোনা,কিন্তু ক্ষুরধার প্রতিভার মানুষটি একাই গণিত নিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়েছিলেন।এরপর খুব অল্প বয়সেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে এই গণিত নিয়েই বিএসসি সম্পন্ন করেন!যে গণিতের প্রতি সবার ভয় কাজ করতো সেটির প্রতিই জামাল নজরুল ইসলামের ছিলো অসীম ঝোঁক!এটাই হয়তো তাঁকে সাধারণদের মাঝে খুব অসাধারণ করে তুলেছিলো।তাইতো ১৯৫৯ সালে মাত্র বিশ বছর বয়সেই দ্বিতীয়বারের মতো অর্জন করে ফেলেছিলেন স্নাতক ডিগ্রি! তাও আবার ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এপ্লাইড ম্যাথম্যাটিকস এন্ড থিওরেটিকাল ফিজিক্স বিভাগ থেকে!তিনবছরের কোর্স দুইবছরেই শেষ করে তারপর আবার একই বিভাগ থেকে তিনি তার ডক্টর অব ফিলোসফি তথা পিএইচডি ডিগ্রি ও গ্রহণ করেন।পোস্ট ডক্টরেট করার সময়ও ছোটবেলার মতোই ডাবল প্রমোশন পেয়েছিলেন অসাধারণ প্রতিভার এই মানুষটি।তাঁর জীবনের এরকম সব কৃতিত্বের কোনো কমতি ছিলো না।জামাল নজরুল ইসলামের বন্ধু ও সহপাঠী কারা ছিলেন তা শুনলেও সবাই অবাক হবে হয়তো।কারন শিক্ষাজীবনে তার সহপাঠী ও বন্ধুদের লিস্টে ছিলেন নোবেলবিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফসন,স্টিফেন হকিং,প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী নারলিকার,নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালাম ও অমর্ত্য সেনের মতো গুণী মানুষগুলো!এইসব নাম গুলো আমাদের সবার কাছেই পরিচিত কিন্তু পরিহাসের বিষয় হচ্ছে এই মানুষ গুলোর সমপর্যায়ের কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তাঁদের চেয়েও উচ্চতায় থাকা নিজের দেশের মানুষটির কৃতিত্বের কথাই আমরা ভালো করে জানি না,কি অদ্ভুত!
➡️জামাল নজরুল ইসলামের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কি কি আছে সেটাও যদি বর্ণনা করতে যাই তাহলেও সুদীর্ঘ এক তালিকা হয়ে যাবে বৈকি!দুইবছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডে কাজ করা,ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করা,লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়া,কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো হিসেবে কাজ করা ও লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিয়ে পরে রিডার পদে উন্নীত হওয়া -এসবই তার জীবনের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে কেবল সমৃদ্ধই করে গেছে।
➡️বিদেশের মাটিতে পড়াশোনা ও গবেষণা করলেও জামাল নজরুল ইসলাম কেবল নিজের দেশেই থাকতে চেয়েছিলেন।তাইতো ১৯৮৪ সালে নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত গুলোর একটি হিসেবে বিলেত আমেরিকার লাখ টাকা বেতনের চাকরি,বিলাসবহুল জীবন ও গবেষণার অফুরন্ত সুযোগকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদালয়ের তিন হাজার টাকার প্রভাষক পদে যোগ দিয়েছিলেন এই সাধাসিধে মানুষটি!আর সেই সাথে স্থাপন করেছিলেন নিজের দেশকে ভালোবাসার এক অনন্য দৃষ্টান্ত!
➡️দেশে ফিরেও বিজ্ঞান সাধনায় নিরলস ভাবে কাজ করে গেছেন এই মহান বিজ্ঞানী!মাতৃভাষায়ও বিজ্ঞান নিয়ে বই লিখেছেন যেন তাঁর নিজের দেশের মানুষদের বিজ্ঞান বুঝতে অসুবিধে না হয়।আমরা সবাই বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় স্টিফেন হকিং এর ভূমিকার কথা জানি কিন্তু এটাই জানিনা যে হকিং এর ‘A Brief History Of Time’ বইটি ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হওয়ার আরও প্রায় ৫ বছর আগেই ১৯৮৩ তে প্রকাশিত হয়েছিলো জামাল নজরুল ইসলামের ‘The Ultimate Fate Of The Universe’ বইটি।অথচ দুইটি বই-ই ছিলো প্রায় একই বিষয়ের উপর লিখা!দুটো বইতেই ব্ল্যাক হোল,সুপারনোভা, কসমিক রে,প্যারালাল ইউনিভার্স ইত্যাদি বিষয়গুলো নিয়ে বলা হয়েছে।তুলনা করলেও জামাল নজরুল ইসলামের বইটিই বিশ্ববিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছে বেশি সমাদৃত কারণ এই বইটিতে মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি নিয়ে বিশেষ ভাবে বলা হয়েছে!অথচ আমরা যারা জামাল নজরুল ইসলামেরই দেশের মানুষ তারা স্টিফেন হকিং এর বইয়ের কথা জানলেও জামাল নজরুল ইসলামের বইটির কথা কয়জনেই বা জানি?
➡️জামাল নজরুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য ভাবে মোট ৬ টি বই লিখেছেন যার মধ্যে ৩ টি বই-ই হার্ভার্ড ও ক্যামব্রিজের মতো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে পদার্থবিদ্যা বিভাগে পাঠ্যবই হিসেবে স্বীকৃত ও বিশ্ববিখ্যাত!তাঁর বিশ্ববিখ্যাত অন্য বই দুটি হলো – Rotating Fields In General Relativty ও An Introduction To Mathematical Cosmology.এইগুলোর মধ্যে ‘দ্য আলটিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স’ বইটি ফরাসি, জাপানি,পর্তুগিজ,ইতালিয়ান সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে।শুধু তাই নয়,এটিই হিব্রু ভাষায় অনুদিত কোনো বাঙ্গালির একমাত্র বই! এছাড়াও তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে ধারাবাহিক ভাবে ৬ টি গবেষণা পত্রও প্রকাশ করেছিলেন।
➡️চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পরে তিনি সেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে উন্নত গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন উন্নতমানের গবেষণা কেন্দ্র।
➡️গণিত দিয়ে বিজ্ঞানকে যে কত সহজেই ব্যাখ্যা করা যায় সেটাই করে দেখিয়েছেন জামাল নজরুল ইসলাম।তা হবে নাই বা কেন!কারন তিনি যে একাধারে পদার্থবিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন গণিতবিদ,জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ!এটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের একটি ঘটনার কথাই বলা যায় তখন দেখা গিয়েছিলো গ্রহ, নক্ষত্রগুলো সব একই সরলরেখা বরাবর চলে এসেছে এই ঘটনার ফলে গুজব রটেছিলো যে দুনিয়া অচিরেই ধ্বংস হতে যাচ্ছে।তখন বাঙ্গালী এই বিজ্ঞানী গণিতের হিসেব কষে সহজেই দেখিয়ে দিলেন গ্রহ নক্ষত্রের এভাবে একসরলরেখা বরাবর চলাটা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের মধ্যেই পড়ে তাই এতে দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার মতো তেমন কোনো ঘটনা ঘটনা ঘটেনি!এই মানুষটা আসলে বাংলার এমন এক গর্ব যার ব্যাপারে বাংলার অধিকাংশ মানুষই জানেনা!অথচ মৌলিক বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে জামাল নজরুল ইসলামেরই ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি।
➡️২০১৩ সালের ১৬ ই মার্চ ৭৪ বছর বয়সে এই মহান বিজ্ঞানী চট্টগ্রামের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ইতিহাসে এই মানুষটির ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
????তথ্যসূত্রঃ-
1.https://www.bd-journal.com/other/164243/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC-%E0%A6%A1.-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
2.https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
3.https://obituary.quantummethod.org.bd/detail/307a6080-a0fe-11e2-b5e3-00270e0b2b42/%E0%A6%A1.%20%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2%20%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2%20%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
https://www.banglanews24.com/feature/news/bd/842988.details
4.https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A7%8D%E0%A6%9E%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80-%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B2-%E0%A6%A8%E0%A6%9C%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%B2-%E0%A6%87%E0%A6%B8%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%AE
✏️লিখেছেন,
নামঃরোমানা আক্তার নিশাত
বিভাগঃফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানঃচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
সেশনঃ২০১৭-২০১৮