করোনা ভাইরাসঃ সাম্প্রতিক আতঙ্ক
ভাইরাস শব্দটির সাথে আমরা সবাই পরিচিত। যার আভিধানিক অর্থ হল বিষ। এক প্রকার অতিক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক অকোষীয় রোগ সৃষ্টিকারী বস্তুর নাম ভাইরাস। উদ্ভিদ ও প্রানী দেহে অসংখ্য রোগ সৃষ্টির মূলে রয়েছে ভাইরাস। এইসব তথ্যই আমরা ছোট বেলায় পুস্তকে পড়ে এসেছি।বিশ্বে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ভাইরাস আবিষ্কৃত হচ্ছে। তারা এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে স্থানান্তরিত হয়, সেখান থেকে মানবদেহেও সংক্রমিত হতে পারে। সম্প্রতি এই ভাইরাস শব্দটির পূর্বে করোনা নামক একটি শব্দের প্রয়োগ আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সারা বিশ্বে। সাম্প্রতিক আতঙ্কের কারণ হলেও শব্দটি একেবারে নতুন নয়।
১৯৬০-এর দশকে মুরগির ব্রঙ্কাইটিস রোগের কারণ খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা সর্বপ্রথম এই ভাইরাসের সঙ্গে পরিচিত হন। এরপরে নানা ধরনের করোনা ভাইরাসের খোজ মেলে। এরমধ্যে ছয়টি(বর্তমানে সাতটি) মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভাইরাসটি হয়তো মানুষের দেহকোষের ভেতরে ইতোমধ্যে ‘মিউটেট করছে’, অর্থাৎ গঠন পরিবর্তন করে নতুন রূপ নিচ্ছে এবং সংখ্যাবৃদ্ধি করছে। ফলে এটি আরও বেশি বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে
২০০২ সালে SARS(Severe Acute Respiratory Syndrome) নামে যে ভাইরাসের সংক্রমনে ৭৭৪ জন লোকের মৃত্যু হয়েছিল সেটিও ছিল মূলত এক ধরনের করোনা ভাইরাস। সেই সময়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় আট হাজার কিংবা তারও বেশি।
পরবর্তীতে ২০১২ সালে MERS(Middle East Respiratory Syndrome) নামক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ২৪৯৪ জনের মধ্যে মৃত্যু বরন করেন প্রায় ৮৫৮ জন।
এই ভাইরাস পরিবারের নতুন সদস্য হল সম্প্রতি চীন সহ সারা বিশ্বে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী ‘নোভেল করোনা ভাইরাস’। এই ভাইরাসটির মানবদেহে সংক্রমনের বিষটি সর্বপ্রথম শনাক্ত করা হয় ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে। পরবর্তীতে WHO এর নাম দেয় ২০১৯-এনসিওভি।
করোনা ভাইরাস কী
করোনা ভাইরাস ভাইরাসের একটি বৃহৎ গ্রুপ,যা প্রানীদের মধ্যে সাধারণ। তবে মার্কিন রোগ প্রতিরোধ সংস্থা গুলির মতে, বিরল ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা এদেরকে Zoonotic(যুনোটিক) নামে অভিহিত করেন,যার অর্থ হল তারা প্রানী থেকে মানুষের মাঝে সঞ্চারিত হতে পারে।
নামকরণঃ
Corona শব্দের অর্থ জ্যোতির্বলয়। সূর্য থেকে ছিটকে পড়া আলোকরশ্মির মতো হওয়ায় ভাইরাসটির নামকরণ করা হয় করোনা ভাইরাস। মানুষ ও পশু-পাখি কখনো কখনো (সব সময় না) এই ভাইরাসটির দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে।
উৎপত্তিঃ
এই ভাইরাসের উৎপত্তি সম্পর্কে এখনো সঠিক ধারণা পাওয়া যায় নি। দুই প্রজাতির সাপ থেকেই করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে বলে এর আগে দাবি করেছিলেন সে দেশের একদল চীনা গবেষক। যদিও করোনা মহামারীর নেপথ্যে সাপই দায়ী কি-না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন আরেকদল গবেষক।
এদেরই একজন ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট ডেভিড রবার্টসন।তিনি বলেছেন স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিই যে নতুন এই করোনা ভাইরাসের বাহক, তার প্রমাণ মিলেছে। কিন্তু সাপ এই ভাইরাসের বাহক, এমন প্রমাণ মেলেনি। ফলে সাপের থেকে মানুষের মধ্যে এই রোগ ছড়িয়ে পড়েছে, একথা বলার মতো কোনও প্রমাণ নেই। যে কারণে এই পরিস্থিতির জন্য সাপকে দায়ী করা যায় না। বিখ্যাত জার্নাল ‘ন্যাচার’কে এমনটি জানিয়েছেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
তবে কোনও প্রাণী থেকে নতুন প্রজাতির করোনা মানুষের মধ্যে ছড়াল, তা এখনও অজানাই বলে তিনি স্বীকার করে নিয়েছেন।
রবার্টসনের এই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত ইউনিভার্সিটি অব সাও পাওলো’র ভাইরোলজিস্ট এডুয়েরডো ব্র্যানডাও। তার মতে, একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখির মাধ্যমেই নতুন এই করোনা ভাইরাস ছড়াতে পারে। তারাই এর বাহক। ফলে সাপকে এই মহামারীর জন্য দায়ী করা যায় না।
যারা ঝুঁকিতে আছেন
বিশেষজ্ঞদের মতে MERS, SARS এবং উহানের করোনা ভাইরাস সাধারণত ৪০ কিংবা তার বেশি বয়সী মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে। তাই বয়স্ক ব্যক্তিরা এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
যেভাবে ছড়ায়
কোন কিভাবে ভাইরাস ছড়াচ্ছে তা নির্ণয় করা গেলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।ধারনা করা হয় পশুর সাথে যোগাযোগ থেকে এই ভাইরাস ছড়ায়। WHO এর অনুসারে বিজ্ঞানীরা মনে করেন MERS এর অস্তিত্ব সর্বপ্রথম উটে পাওয়া গিয়েছিল।SARS এর অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের সন্দেহের তীর রয়েছে সিভেট নামক বিড়ালের দিকে। তবে উহানে সংক্রমনের কারন এখনো সঠিকভাবে জানা যায় নি। তবে এতটুকু জানা গিয়েছে যে এটি প্রানী থেকে মানুষে কিংবা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে।অনেকেই বলছেন উহান শহরে সামুদ্রিক খাবারের পাইকারি বাজার। ধারণা করা হচ্ছে, বেলুগা তিমির মতো সমুদ্রগামী কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী এই ভাইরাস বয়ে এনেছে। তবে বাজারে অহরহ বিচরণ করা মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপের মতো প্রাণীগুলোও সন্দেহের বাইরে নয়।
ভাইরাসটি কতটা সংক্রামক তার উপর নির্ভর করে কাশি,হাঁচি, সংক্রমিত ব্যক্তির ছোঁয়া বস্তু স্পর্শে এমন কি সুস্থ মানুষের মুখ,চোখ বা নাক স্পর্শ করেও এই রোগ ছড়াতে পারে।
লক্ষণ
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কিনা তা এখনো অজানা।তবে এই ভাইরাস কতটা বিপদজনক হতে পারে তার প্রমান আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি।সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে যে সমস্ত লক্ষণ পাওয়া গেছে সবই হাসপাতালে ভর্তির পর। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে সাধারণত যে লক্ষণগুলো ধরা পড়ে সেগুলো হল:
✓ শ্বাসকষ্ট
✓জ্বর,সর্দিকাশি ও গলাব্যথা
✓মাথাব্যথা
✓ নিউমোনিয়া
✓ কিডনিতে সমস্যাসহ নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হয়।
চিকিৎসা
নতুন ভাইরাসটির এখনও কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি। এ কারণে এর ছড়িয়ে পড়া থামানোর আপাতত একমাত্র উপায় হচ্ছে, আক্রান্তদের আবদ্ধ জায়গায় রেখে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পরীক্ষা করা। যারা আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসছেন তাদের পর্যবেক্ষণ করা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে কাজে আসতে পারে। এছাড়া গণজমায়েতে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা যেতে পারে।
করণীয়
এই ভাইরাস থেকে দূরে থাকতে নিম্নোক্ত বিষয়ের উপর জোর দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাঃ
✓আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে কম আসা
✓হাঁচি-কাশির সময় নাক-মুখ ঢেকে রাখা
✓হাত পরিষ্কার রাখা
✓ পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা
✓নিরাপদ খাবার গ্রহন করা
এছাড়াও রোগীর সেবায় নিয়োজিত থাকা স্বাস্থ্যকর্মীরা একটু বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। আর তাই তাদেরকে যথাযথভাবে সংক্রমণনিরোধী বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।
সূত্রঃ
☼বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা
☼নিউ ইয়র্ক টাইমস
☼বিবিসি
☼সিএনএন
☼আলজাজিরা
☼ওয়েভএমডি
☼উইকিপিডিয়া
☼বাংলাদেশ প্রতিদিন
☼কালের কন্ঠ
☼দৈনিক আজাদী
লিখেছেনঃ
ইশমাম ইবনুল আরাবী
এম.এস(জৈব রসায়ন)
রসায়ন বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।