চেরনোবিল বিপর্যয়
?বিজ্ঞানের উন্নতির এক পর্যায়ে পারমাণবিক কেন্দ্র হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার আবিষ্কার মানুষের জীবনে এনে দেয় আমুল পরিবর্তন। এই পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে সাধারণত ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় পদার্থ; যার একটি বিস্ফোরণে হয়ে যেতে পারে অপূরণীয় ক্ষতি। আর ১৯৮৬ সালের ২৬শে এপ্রিল এমনই এক বিস্ফোরণ ঘটে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রে। এই শক্তিকেন্দ্রের ঘটনাটিকে ধরা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতিসম্পন্ন পারমাণবিক বিস্ফোরণ।
কিভাবে ঘটে এ দুর্ঘটনা?
চেরনোবিল পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রে মোট নিউক্লিয় চুল্লী ছিল চারটি এবং প্রতিটি চুল্লী প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিলো।
ভয়াবহ এ দুর্ঘটনাটি ঘটেছিলো চুল্লী নং ৪-এ। একটি অপরিকল্পিত পারমাণবিক পরীক্ষা করতে গিয়ে এটি ঘটে। অপারেটররা এর পাওয়ার রেগুলেটিং সিস্টেম এবং জরুরি নিরাপত্তা ব্যবস্থাটি বন্ধ করে দেয়। এরই সাথে কোরের সাথে সংযুক্ত কন্ট্রোল রডগুলোও বিচিছন্ন করে ফেলা হয়। কিন্তু রিঅ্যাক্টরটি তখনো কাজ করছিলো মাত্র ৭ শতাংশ শক্তি নিয়ে। এসব অপরিকল্পিত কর্মকাণ্ডের কারণে চুল্লীর চেইন রিআ্যাকশন এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তা পরে আর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। এরপর রাত প্রায় দেড়টায় এই চুল্লী বিস্ফোরিত হয়।
দুর্ঘটনা পরবর্তী অবস্থাঃ
চেরনোবিলের ওই বিস্ফোরণের পরপরই মারা যায় ৩১ জন লোক। তবে সবচেয়ে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায় চুল্লীর ভিতরের তেজস্ত্রীয় পদার্থ (বিশেষ করে সিজিয়াম-১৩৭)। এটি পরিবেশে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে এবং ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির সবচেয়ে কাছের শহর প্রিপেট-এ পারমাণবিক বিকিরণের মাত্রা ‘জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ’ স্তরে পৌছে যায়। কিন্তু ওই শহরের ৪০ হাজার লোকের বিস্ফোরণ সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা ছিল না, তারা শুধু জানতেন যে পারমাণবিক প্ল্যান্টে সাধারণ একটি অগ্নিকান্ড ঘটেছে।
শহরের লোকদের সরিয়ে নেয়ার কাজ শুরু হয় বিস্ফোরণের প্রায় ৩৬ ঘন্টা পরে। এর পরের এক সপ্তাহ ধরে সরিয়ে নেয়া হয় আরো ৩০ হাজার লোককে। এদের মধ্যে কয়েকশো লোক মারা গিয়েছিলেন পরবর্তী তিন মাসের মধ্যেই। পরবর্তী মাসগুলোয় এই অঞ্চলের হাজার হাজার লোক থাইরয়েড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। তখন সোভিয়েত সামরিক বাহিনী ওই এলাকাটি পরিষ্কার করার জন্য পুরোদমে কাজ করতে লাগলো।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাটি খুড়ে তা তুলে গর্তে ফেলে তা আবার কংক্রিট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। হেলিকপ্টার দিয়ে বাতাসে পানি ছিটিয়ে তেজস্ক্রিয় ধুলো যেন আরো ছড়িয়ে না পড়ে – সে চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু এ বিস্ফোরণ এতটাই ভয়াবহ ছিল যে এর ফলে ৫০ থেকে ১৮৫ মিলিয়ন কুরি রেডিওনিউক্লাইড পরিবেশে উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই এর তেজস্ক্রিয়তা আশপাশের দেশগুলোতে, যেমন- বেলারুশ, ইউক্রেন, ফ্রান্স ও ইতালিতে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাবঃ
চেরনোবিলের এ বিস্ফোরণের ফলে বন্যপ্রাণীদের উপর তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব খুব সুখকর নয়। জীববিজ্ঞানীদের মতে, এই এলাকায় কিছু পরিমাণ প্রজাপতি, ভোমরা, ফড়িং, ঘাসফড়িং এবং মাকড়সা ছিল। তেজস্ক্রিয়তার ফলে এদের প্রজাতিতে মিউটেশনের প্রভাব দেখা গিয়েছে স্বাভাবিকের থেকে অনেক বেশি। এছাড়া পরিবেশে উন্মুক্ত হওয়া এসব তেজস্ক্রিয় পদার্থ এখানকার গাছপালার উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে।
চেরনোবিলের বর্তমান অবস্থাঃ
পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরপরই এই এলাকায় বসবাসকারীদের সরিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু জনমানবহীন এই এলাকায় এখনও তেজস্ক্রিয়তা ছড়াচ্ছে অবিরত। তাই বর্তমানে চেরনোবিল শহরটি পরিত্যক্ত। প্রায় ৫০ মাইল এলাকা জুড়ে কেউ বাস করে না। আর শক্তিকেন্দ্রে মজুত থাকা প্রায় ২০০ টনের মত তেজস্ক্রিয় পদার্থ পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হতে আরো প্রায় ১০০ থেকে ১০০০ বছর লেগে যাবে বলে গবেষকরা মনে করেন। এছাড়া তেজস্ক্রিয় পদার্থসমূহ মাটিতে পুঁতে ফেলার কারণে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণেরও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
চেরনোবিল বিপর্যয়ের প্রায় তিন যুগ পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু এর বিস্ফোরণের এত বছর পরও এই এলাকার বসবাসের উপযুক্ততা এখনো বিতর্কিত। এখানে যারা আসেন তারা হয় গবেষণার কাজে আসেন, নাহয় পর্যটক হিসেবে ঘুরতে। সরকারি তথ্যমতে, এই দুর্ঘটনার কারণে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ লোক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। তাদের মধ্যে ছিল ছয় লক্ষ শিশু। এই দুর্ঘটনার ফলে ক্ষতির পরিমাণ ২০০ বিলিয়ন ডলারের সমান বলে অনুমান করা হয়েছে। তবে চেরনোবিলের এই দুর্ঘটনা পারমাণবিক শিল্পকে বদলে দিয়েছে। এর ব্যবস্থাপনা এবং কর্তৃপক্ষের কার্যক্রমকে করেছে আরও স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতামুলক।
লিখেছেনঃ
আনিকা নাওয়ার জাহান
পরিসংখ্যান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পোস্টার ক্রেডিটঃ
সোহেল উদ্দিন
উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Tag:blog, chernobyl, chernobylaccident, chernobylzone, cuss, science