পাখিদের “কোয়ান্টাম” চোখ
পৃথিবীতে প্রায় দশ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। এদের প্রায় পাঁচ ভাগ হলো পরিযায়ী পাখি। ইংরেজিতে এদের বলে, মাইগ্রেটরি বার্ডস। শীতপ্রধান দেশের এসব পাখিরা শীতেকালে নিজ বাসভূমি ছেড়ে উড়ে চলে যায় হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে নাতিশীতোষ্ণ কোন অঞ্চলে। সেখানে শীতকালটা তারা কাটিয়ে দেয়। তারপর শীতের শেষে আবার উড়াল দেয় নিজের দেশে। এভাবে বছরের পর বছর পরিযায়ী পাখিরা উড়ে বেড়ায় দেশ হতে দেশান্তরে। হাজার হাজার কিলোমিটার পথ চিনে উড়ে বেড়াতে তাদের কোনোই অসুবিধা হয় না।
প্রতিবছর শীতের সময় আমাদের বাংলাদেশেও পরিযায়ী পাখিরা উড়ে আসে। তখন বিভিন্ন জলাশয়ের আশপাশে এসব অতিথি পাখিদের দেখা যায়। অনেক পাখি আছে যারা তাদের যাত্রাপথে হিমালয় পর্বতের সুউচ্চ শৃঙ্গ অতিক্রম করে। আবার অনেক পাখি অনন্ত গ্রীষ্মের খোঁজে উড়ে বেড়ায় উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরুর মাঝে। এসব পরিযায়ী পাখিকে দ্বিমুখী যাত্রায় চল্লিশ হাজার কিলোমিটারের বেশি পথ অতিক্রম করতে হয়।
পরিযায়ী পাখিদের এই দীর্ঘ যাত্রার ব্যাপারটি যুগে যুগে মানুষকে করেছে বিস্মিত।
মানুষের কাছে রয়েছে কম্পাস, জিপিএস, জায়রোস্কোপ ইত্যাদি অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি। এগুলো দিয়ে মানুষ সহজেই দীর্ঘ যাত্রাপথে নির্ভুলভাবে বিমান অথবা জাহাজ পরিচালনা করতে পারে।
কিন্তু পাখিদের কাছে কি এমন যন্ত্র রয়েছে, যা দিয়ে নির্ভুলভাবে তারাও তাদের যাত্রাপথ নির্ধারণ করে?
পরিযায়ী পাখিরা কিভাবে তাদের পথ চিনে ঠিকমতো তাদের গন্তব্যে পৌঁছে যায় এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক বছর ধরেই গবেষণা করছেন। তবে সম্প্রতি তাঁরা গবেষণা করে যেসব তথ্য পেয়েছেন সেটা সত্যিই বিস্ময়কর।
বিজ্ঞানীরা পরিযায়ী পাখিকে একটি অন্ধকার ঘরে বন্ধ করে শুধু একটি ক্ষীণ আলোক রশ্মি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, বদ্ধ ঘরে পরিযায়ী পাখি সবসময় একটি নির্দিষ্ট দিকেই উড়ার চেষ্টা করে। দেখে মনে হয় কোন এক
অদৃশ্য শক্তি বাইরে থেকে পাখিটিকে ক্রমাগত দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই অদৃশ্য শক্তিটি হলো, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র। বিজ্ঞানীরা জানেন আমাদের পৃথিবীটা একটি বৃহৎ চুম্বক। পৃথিবীর কেন্দ্রে রয়েছে প্রচুর গলিত লোহা। সেটাই হলো পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উৎস। বিজ্ঞানীরা খাঁচার ভেতর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পূর্বাস্য (orientation) পরিবর্তন করে দেখেছেন পাখি এই পরিবর্তনটি বুঝতে পারে।
কিন্তু পাখিরা কিভাবে এই চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাব এবং পরিবর্তন বুঝতে পারে সেটাই হলো বিশাল প্রশ্ন। ইন্দ্রিয় দিয়ে মানুষের পক্ষে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাব বুঝতে পারা সম্ভব নয়। তবে কি পাখিদের অতি সংবেদনশীল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন ক্ষমতা রয়েছে?
সাম্প্রতিককালে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, এই বিশেষ ক্ষমতাটি রয়েছে পাখিদের চোখের ভেতরে। পাখিদের চোখে ক্রিপটোক্রোম (cryptochrome) নামে এক বিশেষ ধরনের আলোক সংবেদনশীল প্রোটিন অণু রয়েছে। পাখিদের চোখ যখন আলোর সংস্পর্শে আসে, তখন আলোর ফোটন কণিকা ক্রিপটোক্রোমের ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম অবস্থানের পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে একটি ক্রিপটোক্রোমের ইলেকট্রন আরেকটি ক্রিপটোক্রোমের ইলেকট্রনের সাথে এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভাষায় একে বলা হয়, এন্টেঙ্গেলমেন্ট। সোজা বাংলায় এর মানে হলো, পরস্পর জড়িয়ে থাকা। এটা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু এর ফলে, ক্রিপটোক্রোমের ইলেকট্রনের সাথে
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের মিথস্ক্রিয়ায় কিছুটা পরিবর্তন হয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা, ক্রিপটোক্রোমের ইলেকট্রনের এই কোয়ান্টাম পরিবর্তন পাখির চোখে আলোক রশ্মির পরিবর্তন হিসেবে ধরা পড়ে। এর ফলে পাখি যখন উড়ে যায়, তখন পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের সামান্যতম পরিবর্তনও তার চোখে আলোক রশ্মির সূক্ষ্ম পরিবর্তন হিসেবে ধরা পড়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই পরিবর্তনের প্যাটার্ন অনুসরণ করেই পরিযায়ী পাখিরা দীর্ঘ যাত্রায় তাদের পথের সন্ধান পায়।
এ নিয়ে এখন আরও গবেষণা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এর সম্বন্ধে আরও তথ্য জানা যাবে।
Tag:Birds