বন, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়নে আইন, পরিকল্পনা ও নীতির প্রয়োগে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ঐকমত্য প্রয়োজন
বাংলাদেশে মানব সভ্যতার ক্রমবর্ধমান অগ্রগতির ফলে বনভূমি ধ্বংস, কৃষিজমির সংকোচন ও নগরায়ন ঘটছে ব্যাপক হারে। এ কারণে বনের উপর নির্ভরশীল ও বসবাসকারী অনেক বন্যপ্রাণী অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চকে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস হিসেবে ঘোষণার পর থেকে বন্যপ্রাণীর অধিকারের বিষয়টি সামনে আসে।
বাংলাদেশে এখন অন্তত ২১৯টি প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপন্ন। এ তালিকায় রয়েছে মাছ, উভচর সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণী। বন বিভাগের হিসাবে মিঠা ও লোনা পানির ৭০৮টি প্রজাতির মাছের মধ্যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে ৫৮টি প্রজাতি। এ ছাড়া ৪২টি প্রজাতির উভচরের মধ্যে ৮টি, ১৫৭টি প্রজাতির সরীসৃপের মধ্যে ৬৩টি, ৭৩৬টি প্রজাতির পাখির মধ্যে ৪৭টি এবং ১২৪টি প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে ৪৩টির অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। বন বিভাগের এক জরিপে বলা হয়, শুধু বনে স্থায়ীভাবে বসবাসকারী হাতি এখন মাত্র ২৪০টি। শুধু হাতিই কমছে না, বনভূমি কমে যাওয়ায় দেশের সমগ্র জীববৈচিত্র্য সার্বিকভাবে সংকটের মুখে পড়েছে। বন্যপ্রাণী দিবস উদযাপন এ বিষয়ে আমাদের সচেতন করে তুলতে পারে। বাংলাদেশ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে মিলে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য তৈরি করে রেখেছে। তবে বিভিন্ন জরিপ থেকে ধারণা মেলে- সামগ্রিক পরিস্থিতি এখানে ভালো নয়।
বন বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে দুই বছরে তিনটি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। ডাঙার সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতি হত্যার ক্ষেত্রেও গত দেড় বছরে নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে। জলের সবচেয়ে বড় প্রাণী তিমি ও ডলফিনের মৃত্যুর হারও উদ্বেগজনক। এ ছাড়া অন্যান্য বন্যপ্রাণী হত্যা ও পাচারও বেড়ে চলেছে দিন দিন । ২০২০ সালে ১২টি হাতি হত্যা করা হয় যার বেশিরভাগ বৈদ্যুতিক ফাঁদ পেতে ও গুলি করে।
বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য বনভূমি ও বন্যপ্রাণীর আশ্রয়স্থানের মধ্যে রয়েছে বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্যে অনন্য বিশ্বের বৃহত্তম নিরবচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বনভূমি সুন্দরবন, সিলেটের সাতছড়ি ও লাওয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, দেশের একমাত্র মিঠাপানির জলমগ্ন বন রাতারগুল সোয়াম্প ফরেস্ট, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি বনাঞ্চল, গাজীপুর ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান, টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় প্রভৃতি। এছাড়া বিভিন্ন বনাঞ্চলকে ধ্বংস থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত বন হিসেবেও ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সরকারি খাসজমির যথাযথ কর্তৃত্ব নির্ধারণ নিয়ে জটিলতা থাকায় প্রায়শ দেশের বিভিন্ন স্থানে বন ও বনজ সম্পদকে ঘিরে সমন্বয়হীনতার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যায় । এ রকম সমন্বয়হীনতার কারণে বনভূমি সংরক্ষণের পরিবর্তে বিভিন্ন স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে হাতির আবাসস্থল সংকুচিত ও তার চলাচলের পথকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, বিগত ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল অবধি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারেই ৪৪টি হাতি নানা কারণে মারা পড়েছে। শুধু তাই নয়, জাতীয় উদ্যান স্বীকৃতির পরও সিলেটের লাউয়াছড়া উদ্যানের মাঝ দিয়ে যাওয়া রেল লাইন কিংবা টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের রাস্তায় প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো বন্যপ্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। এছাড়া উন্নয়নের নামে প্রকৃতি বিধ্বংসী প্রকল্প পরিকল্পনায় প্রকৃতপক্ষে অপউন্নয়ন বাড়ছে। সাংবিধানিকভাবে তাই বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ যে গুরুত্ব পেয়েছে, প্রায়োগিক পর্যায়ে তার প্রতিফলন সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বন ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ যেমন বাধাগ্রস্ত হবে, বৃহত্তর পরিসর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনও দুরূহ হয়ে উঠবে। ব্যাপক হারে বনাঞ্চল উজাড় ও ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসার পেছনে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য কারণ হল ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা ইটভাটা। বন ও পরিবেশের জন্য বিষফোড়া এসব ইটভাটার কাঁচামাল ও জ্বালানির সংস্থান করতে গিয়ে বিরান ভূমিতে পরিনত হচ্ছে একরের পর একর বনভূমি, আবাদি জমির উপরিভাগের মাটি ও বসতভিটার আশেপাশের জমি। বিশেষ করে পাহাড়ের মাটি কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করেই যেভাবে কাটা হচ্ছে এতে পাহাড়ের অস্তিত্ব ইতোমধ্যে হারিয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়। আর এতে বসবাসকারী বন্যপ্রাণীদের বিপন্ন হওয়া তো স্বাভাবিকই বটে। তাই পাহাড়ি বনের প্রতিবেশ ফিরিয়ে আনতে হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের আঞ্চলিক, নৃতাত্ত্বিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, অধিকার সমুন্নত রেখে জাতীয় বন নীতি ও পরিকল্পনার আলোকে ব্যাপকভাবে বন পুনরুদ্ধার ও পুনঃসৃজন কার্যক্রম হাতে নেওয়া প্রয়োজন।
❗ সময়ের সাথে সাথে মানুষ বিবেক বিবর্জিত হয়ে পরিবেশ বিধ্বংসী নানারকম কর্মকান্ডে লিপ্ত হচ্ছে। অর্থ প্রতিপত্তি, সম্পদের মোহে পড়ে মনুষ্য স্বার্থকে (Anthropocentrism) অত্যধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে বন ও পরিবেশের স্বার্থকে (Biocentrism, Ecocentrism) প্রতিনিয়ত যেভাবে ভূলন্ঠিত করা হচ্ছে এতে অদূর ভবিষ্যতে মানব জাতির জন্য বিভীষিকাময় এক অধ্যায় অপেক্ষা করছে। বন ও পরিবেশের উপাদান, স্বার্থ ও সুরক্ষা বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা টেকসই হতে পারে না। অন্তত বৈশ্বিক মহামারী করোনা ও ইতিহাসের কালাপাহাড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগের হাত থেকে উপকূল রক্ষায় ঢাল হিসেবে কাজ করা সুন্দরবন আমাদের সেই বার্তায় মনে করিয়ে দেয়।
✅ বাংলাদেশের বন, বন্যপ্রাণী ও প্রাকৃতিক পরিবেশের বৈচিত্র্য, বৈশ্বিক উন্নয়ন অভীষ্টের ১৫তম সূচক বন আচ্ছাদন তৈরির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাহাড়ি বনের গুরুত্ব অপরিসীম। একইভাবে হাওর, নদী ও সমুদ্রসহ সব জলজ প্রতিবেশকে দূষণমুক্ত রাখাও প্রতিবেশ সংরক্ষণের জন্য সমানভাবে জরুরি। এই মুহূর্তে তাই বন, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের প্রতি রাষ্ট্রের ঘোষিত প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়নে আইন, পরিকল্পনা ও নীতির প্রয়োগে সব সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনগণের ঐকমত্য প্রয়োজন।
References :
1. http://www.bforest.gov.bd/
2. https://www.dailyjanakantha.com/
3. https://www.prothomalo.com/
✏️Content Credits :
Written by :
Minhazur Rahman Shihab
President
Chittagong University Scientific Society.
Photo credit :
Md. Towfiq Hasan
Session: 2015-16
Department of Zoology
University of Chittagong
✨ভাইয়া কে অনেক ধন্যবাদ আপনার ছবিটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ার জন্য।
#World_Wildlife_Day
#cuss