বাংলাদেশের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিন
২৪ই ফেব্রুয়ারিত, বাংলাদেশের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের জন্মদিন।
ঝিনাইদহ জেলার ছোট্ট শহরে জন্ম। নিজের জন্মস্থানের গণ্ডিতে আটকে না থেকে জয় করেছেন মহাবিশ্বের রহস্য। মেধার ছাপ রেখেছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানে৷ হ্যা, বলছি দেশবরেণ্য পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবীদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের কথা৷ মানুষ জন্মায়, বেড়ে উঠে, একসময় পৃথিবী ছেড়ে যায় কিন্তু কর্মনিষ্ঠায় শতাব্দীর পর শতাব্দী বেঁচে থাকেন মানুষের মনে। তিনিও এমনই একজন ব্যক্তিত্ব।
◾চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সায়েন্টিফিক সোসাইটি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে এই অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণার অসাধারণ সাক্ষর ই শুধু রাখেন নি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও ভৌতবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য গবেষণার পথকে করেছেন প্রশস্ত।
তিনি বিজ্ঞান সম্পর্কিত মোট ৬ টি বই লিখেছেন তিনি যেগুলো সারা বিশ্বে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতে অসাধারণ সাড়া ফেলেছে।
পৃথিবী নামক সুন্দর গ্রহে আপনি দিনাতিপাত করছেন,অথচ জানেন কি এই পৃথিবীর উৎপত্তি কীভাবে? কেমন এর অভ্যন্তরীণ গঠন? কী রহস্য লুকিয়ে আছে প্রিয় পৃথিবী ও মহাবিশ্বের সূচনার পেছনে? এই সবকিছু জানতে হলে পড়তে পারেন ‘An Introduction to Mathematical Cosmology ‘ বইটি বাংলাদেশের এমেরিটাস অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলামের রচিত অসাধারণ সাড়া জাগানো এই বইটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি, এর গঠন, পরিবর্তন ও আপেক্ষিকতা সম্বন্ধে গাণিতিক যুক্তিনির্ভর ধারণা দেওয়া হয়েছে বইটিতে৷ বলা হয়েছে কীভাবে অসংখ্য দূরবর্তী ও নিকটবর্তী ছায়াপথের আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে এই পুরো বিশ্ব। এছাড়াও An Introduction to Mathematical Cosmology’ গ্রন্থে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম সমন্বয় করেছেন হাবল নীতিকে। হাবল নীতি অনুযায়ী প্রত্যেকটি দূরবর্তী ছায়াপথ ক্রমান্বয়ে অনেক দূরে পরিভ্রমণ করছে আমাদের ঘিরে। অর্থাৎ মহাবিশ্ব ক্রমশ সম্প্রসারিত হচ্ছে। আবার যতোই বাড়ছে দূরত্ব, ততোই ছায়পথগুলো দূরত্বের সমানুপাতিক গতিতে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের নিকটবর্তী ছায়াপথগুলোর ক্ষেত্রে আবার হাবলের এই নীতি প্রযোজ্য নয়। কারণ, প্রত্যেক দূরবর্তী ছায়াপথের মধ্যে এমন কিছু পদার্থ রয়েছে যা লক্ষহীন তথা নিরুদ্দেশ পথে পরিভ্রমণ করছে। এই লক্ষহীন পরিভ্রমণ ছায়াপথগুলোর দূরত্বের সমানুপাতিক গতিতে দূরে সরে যাওর বেগে বিরাট পার্থক্য সৃষ্টি করছে। শুধু কি নিকটবর্তী নক্ষত্রগুলো? খুব বেশি দূরবর্তী ছায়াপথগুলোও হাবল নিয়ম মানতে পারে না। কারণ এই ছায়াপথগুলো থেকে আরো দূরের আলোও আসতো যা কিনা ১০০ কোটি বছর আগে দেখা গিয়েছিল। পুরনো সেই ছায়াপথ গুলোর লক্ষহীন চলাচলের সাথে বর্তমান যুগের ছায়াপথ গুলোর ভিন্নতা রয়েছে। এরকম সব চমকপ্রদ তথ্যগুলো থেকে একজন জ্যোতির্বিজ্ঞান পিপাসু মানুষ খুব সহজেই বুঝতে পারবে মহাবিশ্বে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটে চলেছে, কী ধরণের পরিবর্তন হয়েছে আর সামনে কী ধরণের পরিবর্তন হতে পারে সে সম্বন্ধে। মহাবিশ্বের পাশাপাশি একশো কোটি বছর আগের পৃথিবী, বর্তমান পৃথিবী আর ভবিষ্যতের পৃথিবী কেমন ছিলো ও থাকবে সে সম্বন্ধেও ধারণা দেয় এই বইয়ে প্রাপ্ত তথ্য৷ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানকে এক অনন্য মাত্রা দিয়েছে জামাল নজরুল ইসলাম কর্তৃক রচিত এই বই।
এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী তার অভূতপূর্ব আলোচনা রয়েছে জামাল নজরুল ইসলাম রচিত আরেকটি বই ‘The Far Universe’ এ। বইটিতে বর্ণনা করা হয়েছে কীভাবে এই পৃথিবী উচ্চ তাপমাত্রা ও উচ্চ ঘনত্ব থেকে প্রসারিত হয়ে পরিবর্তিত হয়েছে। পৃথিবীর এই পরিবর্তনের আদ্যোপান্ত স্থান পেয়েছে বিগ-ব্যাং থিওরিতে। বিগ-ব্যাং থিওরিতে উল্লেখিত মহাবিশ্ব সৃষ্টির কারণ হিসেবে আকষ্মিক বিস্ফোরণের পর আলো বিকিরণকারী পরমাণু, মহাজাগতিক রেডিও তরঙ্গ, মহাজাগতিক স্ফীতির বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের এই বইয়ে৷ বিগ ব্যাং থেকে থেকে পৃথিবীর ও মহাবিশ্বের প্রসারণের হারকে গাণিতিকভাবে বেশ কয়েকটি প্যারামিটারে হিসেব করে পৃথিবীর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে।
এছাড়াও তার রচিত ‘ Classical General Relativity ‘ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সম্বন্ধে। সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে ধারণা দিয়েছিলেন আইনস্টাইন৷ Classical General Theory বইয়ে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বা আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব তথা General Theory of Relativity (GRT) এবং আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বকে একীভূত করে বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম৷ এই তত্ত্বে বলা হয়েছে, দুই বা ততোধিক ভরের মধ্যে পর্যবেক্ষণকৃত মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের কারণ হলো, তারা নিজেদের ভরের দ্বারা আশেপাশের স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। ব্যাপারটি অনেকটা টানটান করে বেঁধে রাখা একটি চাদরের মাঝখানে একটি বেশ ভারী পাথর রেখে দেয়ার মত। পাথর রাখার ফলে চাদরের কেন্দ্রভাগে একটি বক্রতার সৃষ্টি হয়। আবার চাদরের উপর তুলনামূলক কম ভরের আরেকটি পাথর রাখলে তা কেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়বে বা পড়ে যেতে চাইবে। দেখা যাচ্ছে বেশী ভরের পাথরের মাধ্যমে সৃষ্ট বক্রতার কারণে কম ভরের পাথরটি তার দিকে টান অনুভব করছে। মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে এই চাদরটিই হল স্থান-কালের পরিমণ্ডল। একটি বস্তুর কারণে এই পরিমণ্ডলে সৃষ্ট বক্রতাই মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বলের কারণ। আর আইজাক নিউটন মহাকর্ষ বলকে বস্তুসমূহের মধ্যে একটি আকর্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। কিন্তু আইনস্টাইনের এই বক্তব্য ছিল আরও সঠিক। এই সবকিছুর সাথে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তার গ্রন্থে নিজের চিন্তাভাবনা ও গবেষণা জুড়ে দিয়ে বইটিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
মহাকর্ষের মাধ্যমে আলোর বেঁকে যাওয়ার কারণে মহাকাশে একটি মজার ঘটনা পরিদৃষ্ট হয় যাকে বলে মহাকর্ষীয় লেন্সিং। মহাকর্ষীয় লেন্সিং জ্যোতির্বিজ্ঞানে গুরুত্বের সাথে পঠিত হয়। লিগো এবং জিও ৬০০ প্রকল্পের অনেক বিজ্ঞানীই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সরাসরি প্রমাণ পেয়েছেন। কৃষ্ণ বিবর থেকে নির্গত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ অধ্যয়নের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আদি মহাবিশ্বের গঠন বিষয়ে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারেন।
অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম যে কেবল ইংরেজি ভাষায় বই লিখে গবেষণার স্বাক্ষর রেখেছেন তাই নয়। বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘কৃষ্ণবিবর’ ছাড়াও তার বাংলায় আরো দুটো বই রয়েছে। বই দুটো হলো মাতৃভাষা ও বিজ্ঞান চর্চা আর অন্যান্য প্রবন্ধ এবং শিল্প সাহিত্য ও সমাজ। তিনি যেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সেই বিখ্যাত উক্তির ই ধারক ও বাহক যেখানে সত্যেন্দ্রনাথ বসু বলেছেন “ যারা বলে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চা সম্ভব নয় তারা হয় বাংলা বুঝে না নয়তো বিজ্ঞান বোঝে না। “
জামাল নজরুল ইসলাম বাংলা ও ইংরেজি মিলিয়ে ৬ টি উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। এর মধ্যে ৩টি বই বিশ্ববিখ্যাত। ক্যামব্রিজ ও হার্ভার্ডসহ বেশ কয়েকটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বই পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়। তার লেখা বই ‘দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স ফরাসি, জাপানী, পর্তুগিজ, ইতালিয়ান সহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
⭐এই মহান বিজ্ঞানী তার গবেষণা দিয়ে যেমন মহাকাশ গবেষণায় অবদান রেখেছেন তেমনি বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন বিশ্বপরিমণ্ডলে৷ পরিশেষে, অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম তার নাম মেধা ও পরিশ্রম দ্বারা পদার্থবিজ্ঞানের খাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন বহুদিনের জন্য৷ নিঃসন্দেহে তিনি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম।
????????Poster by
Abidul Moula Khan
IT Executive
Department Of Physics
Session : 2019-20
References
1. https://engineersdiarybd.com/jamal-nazrul-islam/
2. https://byjus.com/physics/hubbles-law/
3. https://scholar.google.com/scholar?hl=en&as_sdt=0%2C5&q=jamal+nazrul+islam&oq=#d=gs_qabs&t=1676988506226&u=%23p%3DwHFM13wPCrQJ
4. https://scholar.google.com/scholar?hl=en&as_sdt=0%2C5&q=jamal+nazrul+islam&oq=#d=gs_qabs&t=1676988514655&u=%23p%3Dn7ZMub5HPN8J
5. https://science.nasa.gov/astrophysics/focus-areas/what-powered-the-big-bang