বৃক্ষ নিধনে নয়, বন,পাহাড় ও জলাধার সংরক্ষণ হোক পরিবেশ সুরক্ষার উপজীব্য
বৃক্ষ নিধনে নয়, বন,পাহাড় ও জলাধার সংরক্ষণ হোক পরিবেশ সুরক্ষার উপজীব্য
৫ জুন আরো একটি পরিবেশ দিবস পালন হচ্ছে ধরিত্রীতে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতা নিয়ে মানুষের উদ্বিগ্নতা প্রকটভাবে প্রস্ফুটিত হচ্ছে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ দেরিতে হলেও একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতার জন্য নিজেদের অপরিণামদর্শী আচরণকে উপলব্ধি করতে পারছে। জলবায়ু পরিবর্তন প্রধানত প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুই রকম কারণে হয়। বর্তমান সময়ে তাপমাত্রার অনিয়ন্ত্রিত উঠানামার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মানবসৃষ্ট কান্ডজ্ঞানহীন কর্মকান্ডই মূলত দায়ী। এতদিন জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচকতার জন্য কেবল উন্নত বিশ্বের দেশগুলোকে দায়ী করা হলেও বর্তমানে দেশের দৈনিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, তাপদাহ ও অনাবৃষ্টির জন্য নিজেদের অতিলোভী স্বার্থপর মানসিকতাকে উপেক্ষা করার অবকাশ নেই। যার ফল আমরা দেখছি দেশের বনভূমির ক্রমহ্রাসমান চিত্র থেকে। দিন দিন বনখেকো লোভী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির সমানুপাতে কমছে সবুজ অরণ্য, বিলুপ্ত হচ্ছে সবুজে আচ্ছাদিত বন, পাহাড়, ছায়াশীতল সুনিবিড় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র। বনভূমি ধ্বংসের পিছনে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হচ্ছে সারা দেশে বিভিন্ন শিল্পে জ্বালানির যোগানে ব্যবহৃত নির্বিচারে বনের গাছ নিধনকে।
যেমন, এক মৌসুমে প্রতি ইট ভাটা গড়ে ৪০-৫০ হাজার মণ জ্বালানি কাঠ ও প্রায় ৫ লাখ ঘন ফুট মাটি ইট উৎপাদনে ব্যবহার করে। এরকম প্রায় সাত হাজারের অধিক পরিবেশ বিধ্বংসী ইট ভাটার করাল গ্রাসে জর্জরিত আমাদের পরিবেশ-প্রতিবেশ। চট্টগ্রাম ও এর আশেপাশের ইট ভাটার জ্বালানির যোগান আসে পার্বত্য অঞ্চলের বন থেকে আর মাটির যোগান পায় আশেপাশের পাহাড় ও আবাদি জমি থেকে। দেশে বন ও পরিবেশ সুরক্ষিত রাখতে ২০১৩ সালের ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন (সংশোধিত ২০১৯) অনুসারে জ্বালানি হিসেবে ইটভাটায় কাঠের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমনকি এই আইন লঙ্ঘন হলে ভাটা মালিককে অনধিক তিন বছরের কারাদন্ড বা অনধিক তিন লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান আছে। তারপরও অসাধু ও অসচেতন ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্টরা উৎপাদন খরচ কমাতে বিকল্প জ্বালানি কয়লার পরিবর্তে দেদারসে বনের গাছ কেটে লাকড়ি বানিয়ে জ্বালানিতে ব্যবহার করছে। শুধু তাই নয়, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহের মহোৎসবে মত্ত হয়ে অবৈধভাবে বনের সেগুন, গামার, গর্জন, কড়ই প্রভৃতি গাছ কেটে কাঠ চোরাচালানকারীরা রমরমা ব্যবসা করছে।
আবার, বিভিন্ন গবেষণা রিপোর্টে উঠে এসেছে তামাক চাষ দেশের এক চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংসের পিছনে দায়ী, যেখানে ৩০০ সিগারেট শলাকা তৈরি করতে একটি বড় গাছ পোড়ানোর প্রয়োজন হয়। আবাদি জমিতে খাদ্য শস্য চাষের পরিবর্তে তামাক চাষ লাভজনক হওয়ায় প্রান্তিক চাষীরা ফসলি জমি ও পাহাড়ী বনাঞ্চল উজাড় করে তামাক চাষে ঝুঁকছে। তামাক চাষে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত সার ও কীটনাশক আশেপাশের খাল, ছড়ায় মিশে গিয়ে ভূগর্ভস্থ ও প্রবাহিত পানিকে দূষিত করছে। লাগামহীন ও নির্বিচারে বনের গাছ নিধনের কারণে দিন দিন সমতলের বনভূমি ধ্বংস হয়ে অবশিষ্ট পাহাড়ি বনাঞ্চলও এখন বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। আর এসব বনে বাসকারী বন্য জীবজন্তুর আবাসস্থল অনেক আগেই ধ্বংস হওয়ায় প্রতিকূলতায় টিকে থাকা বাকি প্রজাতিগুলোও এখন বিলুপ্তপ্রায়। বনভূমি ধ্বংসের কারণে যে কেবল পাহাড়ের ক্ষতি হচ্ছে তা না, অনেক জায়গায় পাহাড় ধ্বসে গিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে নদীতে, যেমন হালদা ও কর্ণফুলী নদী, এবং তলদেশ ভরাট হয়ে বিঘ্নিত হচ্ছে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ। এতে বৃষ্টির অভাবে উজান থেকে পানির প্রবাহ কমে গিয়ে নদীর পানিতে জোয়ারের সময় মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততা পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া জলাধার ও জলাভূমি ভরাট করে স্থাপনা নির্মানের কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ হতে না পারায় শহরতলিতে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর শুকিয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। সীমিত সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপচয় এবং পুনঃব্যবহার পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণার অভাবে পানির এমন সংকটের মুখোমুখি নগরবাসী।
নগরায়ন ও শিল্পায়নের ব্যাপকতায় পাহাড় কাটা, ধ্বংস করা, সমতলের আবাদি জমির টপ সয়েল কাটা, বসতি স্থাপন, শিল্প কারখানা নির্মাণ প্রভৃতির ফলে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া ও গাছের ক্রমহ্রাসমান সংখ্যার সাথে কার্বন নিঃসরণের হার বৃদ্ধি গ্রীনহাউজ গ্যাসের প্রধান যোগানদাতা। এছাড়া কলকারখানা নিঃসৃত বিষাক্ত তরল বর্জ্য তো রয়েছেই।
দেশে কেবল লাকড়ি হিসেবে যে পরিমাণ গাছ পোড়ানো হচ্ছে প্রতিবছর তার বিপরীতে কি পরিমাণ গাছ প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে তা ভাববার বিষয়। এই যে বর্তমান সময়ে তীব্র তাপদাহ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, অসহনীয় তাপমাত্রা, বৃষ্টির জন্য হাহাকার ইত্যাদি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন কিন্তুুু এ থেকে উত্তরণে দৃষ্টান্তমূলক কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে খুব একটা দেখা যায় না। কারণ লোলুপ শ্রেণির বন ও পাহাড়খেকোরা রাজনৈতিক ছত্রছায়াকে হাতিয়ার বানিয়ে অল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফা গড়তে বেঁছে নেয় কাঠ ও লাকড়ি ব্যবসা৷ জলবায়ু পরিবর্তনে প্রাকৃতিক কারণ যতটা না আমাদের জন্য ভয়ংকর তার চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণগুলো আরো বেশি হুমকিস্বরূপ। কারণ মানুষের বিবেকহীন কাজসমূহ পরস্পর এমনভাবে সম্পর্কিত যে প্রকৃতির সাথে চরমভাবে অন্যায় বা বিরুদ্ধাচরণ হলেই সেখানে তার ফল ভোগ করতে হয় সামগ্রিকভাবে সবাইকে, যেন প্রকৃতি বিধ্বংসী হয়ে তার প্রতিশোধ নেয়। তাই বলা হয়, প্রকৃতিই তার আপন নিয়ন্ত্রক। তার উপর মানবের অযাচিত হস্তক্ষেপ সে যেন ফিরিয়ে দেয়। সময় থাকতে এখন প্রকৃতির সাথে সখ্যতা বজায় রেখে বাড়ির চারপাশে, সুউচ্চ ভবনের ছাদে, পতিত জমিতে, সড়কের দুপাশে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা অপরিহার্য। তাছাড়া আর যেন কোনো পাহাড় ও বনভূমি দুষ্কৃতকারীদের পেটে চলে না যায় সেজন্য প্রশাসনিকভাবে সংরক্ষণ করা ও দৃষ্টান্তমূলক কঠোর আইন প্রয়োগ জরুরি। জলাধার সংরক্ষণ ও পরিচ্ছন্ন রাখার নিমিত্তে সর্বসাধারনের সচেতনতা আবশ্যক। তবেই প্রকৃতি তার হৃদ্যতায় আমাদের গ্রহণ করতে পারবে।
???? Content Credit :
Written By :
Minhazur Rahman Shihab
President,CUSS
Institute of Forestry and Environmental Sciences
Session :2017-18
Poster Credit :
Abidul Moula Khan
IT Executive, CUSS
Department Of Physics
Session :2019-20
Tag:cuss