মরণঘাতী ড্রাগ LSD
??ঢাবির শিক্ষার্থী হাফিজুলের কথা মনে আছে? যে কিনা নিজের গলা নিজেই ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করেছিল?
বহুল আলোচিত এই ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে এক ভয়ংকর ড্রাগ, তার নাম LSD.
কি এই LSD?
লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইইথ্যালামাইড (LSD) (ইংরেজি: Lysergic acid diethylamide), এক ধরনের সাইকেডেলিক ওষুধ যা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের জন্য পরিচিত। সুইস রসায়ন বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট হফম্যান (Albert Hofmann) LSD এর আবিষ্কারক।
LSD কিভাবে এলো?
১৯৩৮ সালে বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট হফম্যান সানডোজ নামক এক সুইস কেমিক্যাল কোম্পানিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় LSD ড্রাগ আবিষ্কার করেন। তবে তিনি মোটেও মাদক হিসেবে ব্যবহারের জন্য এটি আবিষ্কার করেননি। ত্রিশের দশকে এরগট নামক এক ধরনের প্যারাসাইটিক ফাঙ্গাস দমনের কার্যকরী ওষুধ হিসেবে তিনি LSD আবিষ্কার করেন। আসলে তিনি কম রক্তচাপ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতার উন্নতি শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করার ওষুধ তৈরির জন্য লাইসার্জিক অ্যাসিড নিয়ে কাজ করছিলেন।
ঔষধ থেকে কিভাবে ড্রাগে পরিনত হলো LSD?

১৯৩৮ সালে হফম্যান এই মাদক আবিষ্কারের পর এটি বিজ্ঞানী এবং ফিজিশিয়ানদের কাছে কোনো গুরুত্ব পায়নি। ৫ বছর পর, হফম্যান আবার এলএসডি-২৫ নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। ২৫ মাইক্রোগ্রাম নিজের জিভে স্পর্শ করালেন। এরপরই তিনি চলে যান স্বপ্নের জগতে।
এর তিনদিন পর হফম্যান তার জিভে নিলেন ২৫০ মাইক্রোগ্রাম এর প্রায় দশগুণ বেশি। ফলাফল একই ছিল, তবে ঘাবড়ে যান হফম্যান। দ্রুত চিকিৎসককে ডেকে নিজের ব্লাডপ্রেশার, হার্টরেট, শ্বাস-প্রশ্বাস সবই পরীক্ষা করান। সবই স্বাভাবিক ছিলো। এরপর হফম্যান সহকর্মীরা এই সাইকেডেলিক ড্রাগটি একে একে টেস্ট করলেন। সবাই এটি ব্যবহারের পরপরিই এমন এক নতুন জগতের দেখা পেলেন, যা চিন্তা-ভাবনাকে মুহূর্তেই প্রভাবিত করতে পারে। এভাবেই আবিষ্কৃত হয় ভয়াবহ মাদক এলএসডি। এটি প্রায়ই বল্টার কাগজ, চিনির কিউব, বা জেলটিনে বিক্রি করা হয়। এটি ইনজেকশানের সাহায্যে নেয়া হতে পারে অথবা জিভের নিচে রাখা হয়। নুন্যতম ২০-৩০ মাইক্রোগ্রাম এলএসডি এর প্রভাব উৎপাদনের জন্যে যথেষ্ট।
বাংলাদেশে কিভাবে এলো LSD?
১৫ই জুলাই ২০১৯ সালে মাদকদ্রব্য অধিদপ্তর একটি অভিযানের মাধ্যমে ঢাকার কাফরুল নামক জায়গা থেকে দুজন তরুণকে কিছু LSD এর ব্লটিং পেপার সহ আটক করে। পরে তদন্তের মাধ্যমে জানা যায় যে তারা মূলত এই LSD ড্রাগগুলো নিজেদের গ্রহণের জন্য নিয়ে আসে। পরে তারা এই ড্রাগের বেচাকেনার সাথে জড়িয়ে পরে। পরবর্তীতে গত ২৬শে মে গোয়েন্দা সংস্থার আরেকটি অভিযানের মাধ্যমে জানা যায় যে, এই LSD ড্রাগটি গত ৪ বছর যাবত দেশে বিরাজমান। এই ড্রাগটি বাংলাদেশে আসছে কানাডা, নেদারল্যান্ড এবং মধ্য ইউরোপের কিছু জায়গা থেকে।
LSD এর প্রভাবঃ
LSD মানবমস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কার্যক্রম প্রভাবিত করে। এটি মাদক ব্যবহারকারীর ব্যবহার, অনুভূতি এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করে।
LSD এর পার্শপ্রতিক্রিয়াঃ
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এর সমীক্ষা অনুসারে, এলএসডি গ্রহণের ফলে-
- মানুষের হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাত্রা এবং শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়।
- অনিদ্রা
- ক্ষুধামন্দা
- অতিরিক্ত ঘাম
- নানা ধরণের মানসিক সমস্যা
- এলএসডি গ্রহণ করে ভুল রাস্তা দেখে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া, বাড়ির জানালা দিয়ে লাফিয়ে পড়া
- অহেতুক আতঙ্কিত হয়ে দুর্ঘটনার শিকার হওয়া
- এ ছাড়াও অনেক গবেষণায় উঠে এসেছে যে, বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় ভোগা ব্যক্তিরা এলএসডি গ্রহণের পর আরো বেশি বিষণ্ণতা বা দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারেন।
ইউরোপের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের বাণিজ্যিক ওয়েবসাইট রিসার্চগেইট’এ ২০১৭ সালে প্রকাশিত এক গবেষণার থেকে জানা যায় যে, ১৯৫৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে এলএসডি গ্রহণের পরবর্তী জটিলতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায় মোট ৬৪ জনের মৃত্যু হয়।
কিভাবে মাদক / LSD এর মতো ড্রাগ থেকে যুবসমাজ কে দুরে রাখতে হবে?
সমাজে সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা না থাকলে, নানা ক্ষেত্রে অবক্ষয়, হতাশা বাড়তে থাকলে মাদকাসক্তি বাড়বে। তাই অসুস্থ সংস্কৃতির বলয় থেকে আমাদের বের হতে হবে, মানবিক মূল্যবোধকে আবার জাগরিত করতে হবে। তবেই আসবে মুক্তি।
একসময় আমাদের দেশে যৌথ পরিবারের প্রচলন ছিল। একটি পরিবারে বাবা-মা, সন্তান, চাচা-চাচি, মামা-মামি, ফুফা-ফুফু, নানা-নানি— সবাই একসাথে বসবাস করত। তখন পরিবারের সবার মধ্যে আন্তরিকতার বন্ধন ছিল। ফলে পরস্পরের সমস্যা, দুঃখ-যন্ত্রণা সহজেই সমাধান করতে পারত।
কিন্তু বর্তমানে আমরা সবাই এককেন্দ্রিক হয়ে গেছি। আমরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি না। ফলে দেখা দিচ্ছে অবক্ষয়, অসামাজিক কাণ্ডকীর্তি। তাই এখন প্রয়োজন সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করা। প্রয়োজন, বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক আরও নিবিড় করা।
তবে মাদক নিয়ন্ত্রণের যে চারটি ধাপ আছে তা সবাইকে মনে রাখতে হবে:
১. চাহিদা হ্রাস। এ জন্য গণসচেতনতা প্রয়োজন।
২. সরবরাহ হ্রাস। এ ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগ জরুরি।
৩. ক্ষতি হ্রাস। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে এটি করা যায়।
৪. রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
এ জন্য সরকারেরও আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি নিবিড় পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করা জরুরি। LSD এর মত মরণঘাতী মাদকদ্রব্য যেন দেশে না প্রবেশ করে দেশের যুবসমাজকে ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য সবার সতর্ক থাকা উচিত।
তথ্যসুত্রঃ
Written By:
মোঃ ওয়াসিফ মুরসালিন সাদনান
ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

Poster Credit:
সাদিয়া বিনতে চৌধুরী
উদ্ভিদবিজ্ঞান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।