মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মৃত্যুদিবস
বিজ্ঞান ইতিহাসের কিংবদন্তী, পদার্থবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে যার হাত দিয়ে, তাঁর নাম স্যার আইজ্যাক নিউটন।
তিনি একইসাথে পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং আলকেমিস্ট হিসেবে খ্যাত। অনেকের মতে, নিউটন হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী বিজ্ঞানী।
আজ ৩১শে মার্চ, ২০২৩; মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটনের মৃত্যুদিবস। ১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে তিনি এই প্রিয় অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতির কাছ থেকে চিরদিনের জন্য পরলোকগমন করেন।
জন্ম ও ছেলেবেলা:
আধুনিক বর্ষপঞ্জি অনুসারে, ১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারিতে ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার কোলস্টারওয়ার্থ গ্রামের ‘উলসথর্প’ নামের এক বিশাল ফার্ম হাউসে তিনি জন্মগ্রহন করেন। আমরা যাকে আইজ্যাক নিউটন হিসেবে জানি তাঁর পিতার নামই ছিলো মূলত আইজ্যাক নিউটন। তিনি তাঁর পিতা আইজ্যাকের মৃত্যুর তিন মাস পর জন্ম নেন। এই সন্তান তাঁর বাবাকে কোনো দিন দেখেননি। তাই বাবার নাম অনুসারেই তাঁর নাম রাখা হয় আইজ্যাক নিউটন। মা হ্যানা দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হলে শিশু নিউটনকে তার বাবা মায়ের কাছে রেখে চলে যান।
শিক্ষা:
নিউটনের প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন হয় বাড়ির পাশের এক ক্ষুদ্রায়তন স্কুলে। ১২ বছর বয়সে নিউটনকে গ্রান্থাম গ্রামের কিং স্কুলে ভর্তি করানো হয়। স্কুল জীবনের প্রথম থেকেই নিউটনের সবচেয়ে বেশি ঝোঁক ছিল বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরির প্রতি। সেই বয়সেই তিনি বায়ুকল, জল-ঘড়ি, ঘুড়ি এবং সান-ডায়াল তৈরি করেছিলেন।
১৬৬১ সালে ১৯ বছর বয়সে কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন নিউটন। তবে তিনি সিলেবাসের পড়াশোনা বাদ দিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো পড়াশোনা করছিলেন। সে সময় তিনি মূলত গণিত ও বলবিজ্ঞান, কেপলারের আলোকবিজ্ঞান বিষয়ক সূত্র, ইউক্লিডের জ্যামিতির প্রতি অধিক মনোনিবেশ করেন এবং জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন।
১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি লাভের প্রাক্কালেই নিউটন তার বিখ্যাত দ্বিপদী উপপাদ্য বিষয়ক সূত্র প্রমাণ করেন। ট্রিনিটি কলেজের এই দিনগুলো তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ১৬৬৫ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ এবং লন্ডনে প্লেগ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে। এর ফলে কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৬৬৫ এবং ১৬৬৬—এই দুই বছর নিউটন তাঁদের উলসথর্পের ফার্মে কাটান। এই দুই বছরের নিভৃতবাসের সময় তিনি আবিষ্কার করেন তাঁর যুগান্তকারী সূত্রগুলো। তিনি আবিষ্কার করেন ক্যালকুলাস, আলোর প্রকৃতি, মহাকর্ষ সূত্র। এই দুই বছরে তিনি যত কিছু আবিষ্কার করেছেন, সেগুলোই পরবর্তী ২০০ বছর ধরে নির্ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের পাঠে এবং গবেষণায়। ১৬৮৭ সালে প্রিন্সিপিয়া তে নিউটনের এসব আবিষ্কার প্রকাশিত হয়।
✒️ কর্ম:
আইজ্যাক নিউটন ১৬৬৯ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির লুকাসিয়ান প্রফেসর পদে যোগ দেন। পরবর্তী ৩৩ বছর তিনি সেই পদে কাজ করেছেন। নিউটন তখন আলোকবিদ্যা সম্পর্কে গবেষণা করছেন। লুকাসিয়ান লেকচারে তিনি সেসব তত্ত্বই আলোচনা করছিলেন। কিন্তু কোনো ছাত্রই আগ্রহী হননি তাঁর লেকচারে। প্রথম লেকচারে কয়েকজন উপস্থিত থাকলেও দ্বিতীয় লেকচারে কেউ উপস্থিত হননি। নিউটন খালি থিয়েটারেই লেকচার দিলেন। পরবর্তী ১৭ বছর ধরে নিউটন লুকাসিয়ান লেকচার দিয়েছেন খালি থিয়েটারে। প্রফেসর হিসেবে খুবই অবহেলিত ছিলেন আইজ্যাক নিউটন। তাঁর অধ্যাপনা জীবনে মাত্র তিনজন ছাত্র তাঁর কাছে পড়তে এসেছিলেন।
গবেষণা ও আবিষ্কার:
নিউটন গণিতের এমন একটি নতুন শাখার উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন যা ক্যালকুলাস নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি গণিত এবং পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে একটি বিপ্লবের জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছিল। এছাড়াও নিউটন দ্বিপদী উপপাদ্যের একটি সাধারণ রুপ উদ্ভাবনের জন্য বিখ্যাত।
আলোকবিজ্ঞানে তিনি আলোর প্রতিসরণ আবিষ্কার , প্রিজমে সাদা আলোর বর্নালী বিশ্লেষণ এবং আলোর কণাতত্ত্ব সহ অনেক মৌলিক ধারণা দেন। ১৬৮৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিশ্ব নন্দিত গ্রন্থ ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশিত হয় যাতে তিনি সর্বজনীন মহাকর্ষ এবং গতির তিনটি সূত্র বিধৃত করেছিলেন। এই সূত্র ও মৌল নীতিগুলোই চিরায়ত বলবিজ্ঞানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে, আর তাঁর গবেষণার ফলে উদ্ভূত এই চিরায়ত বলবিজ্ঞান পরবর্তী তিন শতক জুড়ে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার জগতে একক আধিপত্য করেছে।
আলবার্ট আইনস্টাইন নিউটন সম্পর্কে বলেছিলেন, প্রকৃতি তাঁর হাতে স্বেচ্ছায় ধরা দিয়েছে। প্রকৃতির রহস্য নিউটনের মতো করে আর কেউ এতটা উন্মোচন করতে পারেননি। নিউটনের হাত দিয়েই আমরা পেয়েছি আলো এবং বর্ণের সম্পর্ক, মহাকর্ষ বলের গাণিতিক সূত্র ও গতির সূত্র।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে রয়েল সোসাইটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি এ প্রশ্ন নিয়ে একটি ভোটের আয়োজন করে। ভোটের ফলাফলে দেখা যায়, এক্ষেত্রে নিউটন আইনস্টাইনের চেয়েও অধিক প্রভাবশালী।
নিউটনের বৈজ্ঞানিক গবেষণাসমূহ তাঁকে প্রভূত সম্মান এনে দিয়েছিল। ১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি নাইট উপাধিতে ভূষিত হন। সমগ্র মহাদেশ থেকেই তাঁর জন্য বিভিন্ন সম্মাননা এসেছিল। এতো সম্মান পেয়েও নিউটন এক সময় বিনয় প্রকাশ করেছেন।
⚰️ মৃত্যুঃ মৃত্যুর কিছুকাল পূর্বে তিনি বলেছিলেন- “আমি জানিনা বিশ্বের কাছে আমি কীভাবে উপস্থাপিত হয়েছি, কিন্তু আমার কাছে আমার নিজেকে মনে হয় এক ছোট বালক যে কেবল সমুদ্র উপত্যকায় খেলা করছে এবং একটি ক্ষুদ্র নুড়ি বা ক্ষুদ্রতর এবং খুব সাধারণ পাথর সন্ধান করছে, অথচ সত্যের মহাসমুদ্র তার সম্মুখে পড়ে রয়েছে যা অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেল”।
১৭২৭ সালের ৩১ মার্চ লন্ডনের কেনসিংটন এ মাত্র ৮৫ বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর মৃত্যু কে ঘিরে রয়েছে নানান রহস্য। ধারণা করা হয় তাঁকে স্লো পয়জনিং এর মাধ্যমে মারা হয়েছিল। কারণ মৃত্যুর পর তাঁর চুল থেকে মার্কারী পাওয়া গিয়েছিল যা ছিল এক ধরনের পয়জন মেটাল। অনেকের ধারনা এই মার্কারী থেকে তাঁর Nephrotic Syndrome হয়েছিল।
♣️এছাড়াও আরো অনেক ধরনের রোগে জর্জরিত ছিলেন তিনি। নিউটনের জন্মই হয়েছিল Low Birth Weight বেবী হিসেবে। বলা হতো – তাঁকে নাকি অনায়াসে একটি কোয়ার্ট মগের ভিতর ঢুকিয়ে দেওয়া যেত। ছোটবেলা থেকে পারিবারিক বিভিন্ন রকম সমস্যার জন্য তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। কারো সামান্য কথায় তিনি মারাত্মকভাবে রেগে যেতেন। পরে তিনি Bipolar Disorder নামের মানসিক রোগে মারাত্মক রকমভাবে আক্রান্ত হন।
স্যার আইজ্যাক নিউটনের এক ধরনের নিউরোলজিক্যাল ডিজিজ , Asperger’s Syndrome ও ছিল। এছাড়া তার Personality Disorder এতোই ভয়াবহ ছিল যে কেউ তার সাথে মিশতেও সাহস পেত না।
☢️নিউটনের আরেকটি রোগ ছিল Gout। তার জয়েন্টে প্রায়ই প্রচন্ড ব্যাথা হতো । একসময় তাঁর ইউরিক এসিড স্টোন হয়েছিল। তাঁর চিকিৎসক তাঁকে বলেছিলেন – “No hope of recovery” । পরবর্তীতে তাঁর Urinary Incontinence ডেভেলপ করে।
স্যার আইজ্যাক নিউটন কে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি তে সমাহিত করা হয়। তাঁর কবরের উপরেই তাঁর স্মৃতি স্মারক করা হয়।
⭕নিউটনের মূর্তিকার হলেন মাইকেল রিজবার্ক এবং ডিজাইনার ও বাস্তুকার হলেন উলিয়াম কেন্ট। মূর্তিটি সাদা এবং ধূসর রঙের মিশ্রনে করা হয়েছে।
#cuss
#IssacNewton
References:
1.https://www.bigganchinta.com/physics/newton-life-and-science
2.https://www.wikiwand.com/bn/%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%9C%E0%A6%BE%E0%A6%95_%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%9F%E0%A6%A8
3.https://www.sosastho.com/2017/07/death-of-newton.html?m=1
4.https://sonobangla.com/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%9F%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%86%E0%A6%AA%E0%A7%87%E0%A6%B2/
Content Credit :
✏️Written By :
Sanjana Tabassum Nova
Department Of Physics
Session : 2019-20
Poster Credit :
Abidul Moula Khan
IT Executive
Department Of Physics
Session : 2019-20