স্যার জগদীশচন্দ্র বসু
২৩ নভেম্বর,স্যার জগদীশচন্দ্র বসুর মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৩৭ সালের এইদিনে তিনি পরলোকগমন করেন। এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। তাঁকে নিয়ে আমার আগের লেখাটি আবার শেয়ার করছি।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর আবিষ্কার
জগদীশ চন্দ্র বসুর জন্ম হয়েছিল ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল ঢাকার অদূরে বিক্রমপুরে। গ্রামের নাম রাঢ়িখাল। কিন্তু জগদীশ চন্দ্রের জন্ম হয়েছিলে ময়মনসিংহে। তাঁর পিতা ভগবান চন্দ্র বসু সে সময় ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পরবর্তীতে তিনি ইংরেজ সরকারের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন।
ইংরেজ সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ভগবান চন্দ্র তাঁর ছেলেকে প্রথমে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করেননি। জগদীশ চন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা হয়েছিলো বাংলা স্কুলেই। তাঁর বাবা মনে করতেন ইংরেজি শেখার আগে ছেলের বাংলা ভাষাটা ভালো করে শেখা দরকার।
ছোটবেলায় বাংলা স্কুলে পড়াটা জগদীশচন্দ্র বসুর জীবনে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। এর প্রমাণ হলো বাংলা ভাষায় রচিত তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ গুলো। ভাষার প্রতি ভালোবাসা ছাড়াও তাঁর বাবা চেয়েছিলেন জগদীশ চন্দ্র দেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিলেমিশে বড় হোক। তাঁর মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক।
ছোটবেলা থেকেই জগদীশ চন্দ্র ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। বিজ্ঞানে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ।
বাবা চেয়েছিলেন ছেলে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। দেশের মানুষের সেবা করবে। তাই তিনি জগদীশ চন্দ্রকে ডাক্তারি পড়তে পাঠালেন ইংল্যান্ডে। কিন্তু বিধি বাম। শারীরিক অসুস্থতার জন্য জগদীশ চন্দ্রের ডাক্তারি পড়া হলো না। ডাক্তারি পড়া বাদ দিয়ে তিনি পড়াশোনা করলেন পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে। বিলেতে পড়াশোনা করার সময় তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী বিশ্বখ্যাত পদার্থ বিজ্ঞানী লর্ড রেইলিকে। জগদীশ চন্দ্র ছিলেন তাঁর একজন প্রিয় ছাত্র। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে ডিগ্রী নিয়ে তিনি ফিরে আসলেন। যোগ দিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন ধরনের গবেষণায় ব্যস্ত থাকতেন। যদিও ওই কলেজে সে সময়ে গবেষণার তেমন কোন সুযোগ ছিল না। তারপরও তিনি সেখানে নানা ধরনের মৌলিক গবেষণা করেছিলেন সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে। প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর প্রথম আঠারো মাসের গবেষণার ফলাফল ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। এরই সূত্র ধরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ১৮৯৬ সালে ডিএসসি ডিগ্রী দেওয়া হয়েছিল।
জগদীশ চন্দ্র বসুর সেই আঠারো মাসের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ। তিনি কাজ করছিলেন অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ নিয়ে। ১৮৯৪ সালে তিনি তাঁর কলকাতার গবেষণাগারে বসে কোন তার ছাড়াই মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গকে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসব অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ বর্তমানে রেডার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। তবে জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর এই মৌলিক আবিষ্কারটি কখনো পেটেন্ট করেননি। তিনি প্রথাগত বিজ্ঞানীদের মত পেটেন্ট নিয়ে ভাবতেন না। তিনি তাঁর সব আবিষ্কারকে উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন অন্যদের জন্য। তাঁর মতে আবিষ্কর্তার চেয়ে আবিষ্কারটাই হলো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে তাঁর অভিমত ছিলো জ্ঞান-বিজ্ঞান হবে উন্মুক্ত। তিনি পেটেন্ট প্রথার বিরোধী ছিলেন।
পরবর্তীতে অবশ্য ইটালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি শর্ট ওয়েভ ব্যবহার করে বেতার যন্ত্র আবিষ্কার করার কৃতিত্ব লাভ করেন। তবে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মনে করেন জগদীশ চন্দ্র বসু তড়িৎ চুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। বেতার তরঙ্গ প্রেরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কৃতিত্বটি তাঁরই পাওয়া উচিত ছিল। ২০১২ সালে ইনস্টিটিউট অফ ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স (IEEE) মাইক্রোওয়েভ
তরঙ্গ প্রেরণের ক্ষেত্রে তাঁর অগ্রণী ভূমিকাকে বেতার যোগাযোগের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
জগদীশচন্দ্র বসু মূলত একজন পদার্থবিজ্ঞানী হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়েও যুগান্তকারী গবেষণা করেছিলেন। আমাদের দেশে অবশ্য এ নিয়ে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। সবাই মনে করে স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু “গাছের প্রাণ আছে” এই বিষয়টি আবিষ্কার করেছিলেন। গাছের যে প্রাণ বা জীবন আছে সেটা মানুষ বহু আগে থেকেই জানতো। যুগ যুগ ধরে মানুষ দেখেছে যে গাছের জন্ম হয়, মৃত্যু হয়, গাছ বৃদ্ধি পায় এবং বংশ বিস্তার করে। প্রাণের সব লক্ষণ গাছের মধ্যে আছে। উদ্ভিদবিজ্ঞান জীববিজ্ঞানের একটি শাখা হিসেবে কয়েক শতাব্দী থেকেই প্রতিষ্ঠিত। তাহলে তাঁর মূল আবিষ্কারটি আসলে কি ছিল?
মানুষ জানতো প্রাণীদের মতো গাছের কোনো স্নায়ুতন্ত্র নেই। তাই মানুষ মনে করতো প্রাণীদের মতো গাছের কোনো সংবেদনশীলতা বা সেন্সেশন নেই। কিন্তু জগদীশ চন্দ্র বসু প্রমাণ করেছেন গাছের ও সংবেদনশীলতা রয়েছে। তিনি সেটা মাপার জন্য একটি যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। এই যন্ত্রটির নাম তিনি দিয়েছিলেন ক্রেস্কোগ্রাফ। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি গাছের মধ্যে সামান্যতম পরিবর্তনও রেকর্ড করতে পারতেন। তিনি তাঁর পরীক্ষাগারে গাছের উপর বিভিণ্ণ ধরণের উদ্দীপক, যেমন বিদ্যুৎ, তাপ, গ্যাস, কেমিক্যাল ইত্যাদি প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে গাছ সে সব উদ্দীপনায় সাড়া দেয়। তাঁর ক্রেস্কোগ্রাফে সেটা ধরা পড়ে। এই যুগান্তকারী আবিস্কারটির জন্যই তিনি জগৎ বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের জন্য তাঁকে নাইটহুড বা স্যার উপাধি দেয়া হয়েছিল।
স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্য চর্চাও করতেন। বাংলা ভাষায় তিনি বিজ্ঞানের অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম সাইন্স ফিকশনের লেখকও তিনি ।
শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন অনবদ্য। তাঁর প্রথিতযশা ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রমুখ বিজ্ঞানী। ১৯১৭ সালে বিজ্ঞানের বিভিন্ন মৌলিক এবং ফলিত বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি স্থাপন করেছিলেন বোস ইনস্টিটিউট। আমাদের উপমহাদেশে এটিই ছিল সর্বপ্রথম বেসরকারি উদ্যোগে স্থাপিত গবেষণা প্রতিষ্ঠান। তিনি জানতেন বিজ্ঞানের উন্নতি ছাড়া স্বদেশের উন্নতি সম্ভব নয়। সেজন্য বিজ্ঞানের উন্নতি কল্পে সারাজীবন কাজ করে গেছেন তিনি। ১৯৩৭ সালে এই ক্ষণজন্মা বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর সম্মানে চন্দ্রপৃষ্ঠের একটি গহ্বরের নামকরণ করা হয়েছে, বোস ক্রেটার। চাঁদের বুকে স্থান পেয়েছে জগদীশ চন্দ্রের নাম। বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু অমর হয়ে আছেন চন্দ্রপৃষ্ঠে।
© Tanvir Hossain